Tuesday, November 19, 2024
Tuesday, November 19, 2024
Homeআলোচনানাটক ‘বিকলাঙ্গ’ বিকল সমাজ চালচিত্রে নিষিদ্ধ ভাবনার বিরুদ্ধেই গড়ে ওঠা নিষ্ঠুরতার নির্মম...

নাটক ‘বিকলাঙ্গ’ বিকল সমাজ চালচিত্রে নিষিদ্ধ ভাবনার বিরুদ্ধেই গড়ে ওঠা নিষ্ঠুরতার নির্মম কান্না

দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা

একটি ব্যতিক্রমী নাটক ‘বিকলাঙ্গ। অশুভ বাতাবরণের বাতাসে উড়ে চলা আদর্শের পঙ্গুত্ব দশাই জন্ম দিয়েছে এই বিকলাঙ্গ নাটকের। যে সমাজ কোন বিপ্লবীর জন্ম দেয় না। জন্ম দিচ্ছে আত্মম্ভর স্বার্থপর দূর্নীতিবাজ অজস্র মানুষের। এই আলোতেই আলোকিত একটি বিষয় এসেছে এই নাটকে। যা সত্য সৎ সাধুতার গর্ভে, জীবন সায়াহ্নের প্রৌঢ়ত্বে উপলব্ধ জীবন যন্ত্রণায় বাঙ্ময় হয়েছে। অবসাদ মাখা নিরুপায় পরিস্থিতিতে চরম হতাশার বিচিত্র বিচ্ছুরণ। কোথাও যেন আলো নেই। অন্ধকারের কুয়াশায় ঢাকা দিগন্ত,….প্রায় শেষ হতে বসেছে আশা। প্রত্যাশার নিবাসে মনে আর কিছুই কাঙ্ক্ষিত নেই। মরে গেছে চাওয়া পাওয়ার স্নিগ্ধ হস্তান্তর। কারণ প্রতিশ্রুতি হবে যারা, যারা  ছিল অবলম্বন। তারাই গেছে বদলে। তাই এখন আর আঁকড়ে ধরে ভরসায় ভর দেবার মত চারপাশে সত্য সততা সাধুতার কোন প্রতিকৃতি নেই। নেই বিপন্নতায় ভারসাম্য রক্ষা করা সত্য শক্ত খুঁটি।

বিকলাঙ্গ গল্পে, জগন্নাথ দত্ত একজন আদর্শবাদী শিক্ষক। যে মানুষ, নিজের সংযত জীবনবোধে, নিদারুণ দারিদ্রে, অবসরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে, বিনা পয়সায় ছেলে টুটুনের সাথে, তার বন্ধু অর্ঘ, শুভ্র, রজত এই ছাত্রদের দীর্ঘদিন পড়িয়েছেন। সবার প্রাণে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার ব্রতেই বিভোর থেকেছেন। একটি আদর্শিক ভবিষ্যত পেতে অক্লান্ত শ্রমে কেবলই এইসব মেধাবী ছাত্রগুলির মানুষ হয়ে ওঠা পথে, মানবিক অস্তিত্বের বিচ্ছুরণ চেয়েছেন। যিনি সমাজের মন-ভূমিকে কর্ষণ করেই সমাজ কল্যাণে নিজের ছেলে(টুটুন), ছেলের সহপাঠী বন্ধু হয়ে ওঠা ডাক্তার এবং ঘটনা চক্রের জামাই(অর্ঘ), আরেক বন্ধু (প্রশাসনিক কর্তা আই পি এস রজত গুপ্ত), এবং সেদিনের অন্য বন্ধু (ক্ষমতাবান জনপ্রতিনিধি এম এল এ শুভ্রকান্তি দত্ত) প্রমুখদের, স্কুল লেভেলের শিক্ষায় কেবলই, সাহিত্য ইতিহাস ভূগোলের ভিতরে কল্যাণকামী স্বপ্নময়তা ছায়ায় গড়ে গেছেন। যিনি আত্ম বিশ্বাসে আশাবাদী অবস্থায় মানুষকে হয়ে উঠতে বিশ্বাস করেছেন। যিনি শিক্ষাকে উচ্চতর উচ্চারণে স্থান দিয়েই নিরন্তর হাসিতে ভেসে যাবেন বলে আগামীর সময়কে এদের অন্তরের সাথে বিনি সুতোর তারে বাঁধতে চেয়েছেন। যিনি ভাবতেই পারেননি, এই আত্মজ সমান অনুজদের অসাধুতার চরম থাপ্পড় তিনিই একদিন খাবেন। তার ত্রিভূবণ কেঁপে উঠবে, বিচিত্র যন্ত্রণায়, একেবারে হাতে গড়া পুতুলের ছলাকলায়। নিজের জীবনের নির্মম পাওনা পাওয়ায় এমন এক নিষ্ঠুর পৃথিবী ফিরে পাবেন। তা হয়তো ভাবাই হয় নি। নুলো জগন্নাথ, অক্ষম। ভবিষ্যৎ অক্ষরের বর্ণমালা বুঝে নিতে ব্যর্থ। কারণ যিনি ছবি আঁকেন, তিনি সেই ছবির রঙ আপনা আপনি পাল্টে যাওয়া ভেবে উঠতে পারেন না। সেখানেই আছে কিছু বিকারগস্ত ভবিতব্য।

কেননা এই চারটি কিশোরের পরিণত জীবন-প্রতিষ্ঠা, জীবন যাপন, একটা সংঘটিত অপরাধে চার বন্ধুর নির্বিকার সহযোগ দান, তার সামনে এক অদ্ভুত আঁধার এভাবে যে নিয়ে আসবে। আসতে পারে। তা তিনি ভাবতেই পারেন নি। যেখান থেকেই তিনি নিজেও একটা চোরা স্রোতে ভেসে গেলেন। নির্মম নিষ্ঠুর এই নির্মাণ এক কালসন্ধ্যার আগাম সংকেত।

আসলে নিজের মেয়ে স্বান্তশীলার সাথে ছাত্র কাম ডাক্তার অর্ঘের প্রণয় এবং বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। সততা আর অসততার অসতর্ক আলাপে বিরোধ গড়ে উঠেছিল। তাই মাতৃত্বের অসুস্থতায় অর্ঘ ডাক্তারের বিনাশী ওষুধে ঘটে স্বান্তশীলার এক চিকিৎসাগত হত্যা। সে মারা যায়। স্বামীর অবহেলা চক্রান্তে। যেহেতু স্বান্তশীলার সাথে বাবা জগ্ননাথের এক হৃদয় বৃন্তেই শুদ্ধতায় আত্মীক সম্পর্ক ছিল। তাই এই মৃত্যুর সত্য উদঘাটন করতে জগন্নাথ সচেষ্ট হন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তাদের টাকা আর ক্ষমতার চক্রবূহ্যে আছড়ে পড়ে তিনি ব্যর্থ হন। জানা যায় নিজের ছেলে অনৈতিক হয়ে পড়েছে। কেননা টুটুনও ক্ষমতায় টাকায় দূর্নীতিতে বন্ধুদের সাথে চিয়ার্স জীবনেই আছে। অতএব উপায় কী? আই পি এস রজত গুপ্ত, এম এল এ শুভ্রকান্তি দত্তেরা সবাই অর্ঘ টুটুনের গলায় গলায় সম্মিলিত অহংকার। তাই জগন্নাথের জীবন সায়াহ্নে পেছনে তাড়া করে ফেরা চারিদিকের অন্যায় অপরাধের মুক্ত বাতাবরণ, তাকে বিচলিত করেছে। পরিস্থিতি গত এই যন্ত্রণা দগ্ধ উৎপাতের উদ্ভুত বিস্ময়ে চমকে উঠে তিনি প্রথমে স্থবির হয়ে গেছেন। কিন্তু চলা থামান নি। শিক্ষকতার মহার্ঘতাও কমে নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরো শিশু/বালক ছাত্রদের মুখে যখনই তিনি বড় হ’য়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি টাকা উপার্জন কামী লোলুপতার কাঙালপনা দেখেছেন। তখনই তার মাথা বিগড়ে গেছে। মালটিপল পার্সোনালিটি ডিসওর্ডারে আক্রান্ত জগন্নাথের নিজের ভেতরে পথ খোঁজা সাপ কিলবিলিয়ে উঠেছে। ভেবেছে জগন্নাথ মনন…..আবার অর্ঘ টুটুন শুভ্র রজত দের উত্থান অনুকরণীয় গল্পের পুনরাবৃত্তি? তখন একট্ব দেরি না করে, মনের বিচারে, তার অন্তরের কুলুঙ্গি থেকে টেনে নামিয়ে ফেলেছেন বিনাশী অধঃপতিত দুষ্ট শাসনকে। অবাক হবার বিষয়, এই আদর্শবাদী শিক্ষক হয়ে উঠছেন এক সিরিয়াল কিলার। স্বশিক্ষিত বিধানে নিজেকেই সঁপে দিচ্ছেন ধ্বংস মুখিনী বয়ে চলা আত্ম বিচারের দোলায়। আত্ম সমর্পণে এখন জেলের কয়েদি। হয় ফাঁসির দড়ি ঝুলছে। ঝুলুক, তবুও তার নিজের হাতে গড়া প্রাণ প্রতিমাকে আছড়ে ভাঙ্গতে বিন্দুমাত্র লজ্জা পান নি। অনায়াসে মন থেকে মুছে ফেলছেন এতদিনের লালিত হৃদয়বৃত্তিকে।

মানুষ গড়ার এক শুদ্ধস্বর কারিগর, আজ বাস্তবতার চাপে পড়ে নিজেই নিজের সুকোমল বৃত্তিকে হত্যা করেছেন। অবসাদের চরম অবস্থানে পৌঁছে, নিজের ভেতরের জান্তব শক্তিকেই আবাহন করছেন। ন্যায় নীতির ধার না ধারা এই সময়ের আত্ম সর্বস্বতার প্রতিবিধানের উৎস পথে ছুটে গেছেন। শিশু হত্যায় অবিবেচক হন্তারক হ’য়ে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে শব সাধনা করছেন। নীতি থেকে বেরিয়ে অবলীলায় সমাজ বিরুদ্ধ অনৈতিকতার শীর্ষ স্থানে চলে যাচ্ছেন। এসব থেকেই বুঝতে বাধ্য করে বিকলাঙ্গ নাটক, সময়ের অন্ধকার ক্রমে কীভাবে আমাদের আশাকে গিলে খেয়েছে। কেন, কোন মর্মে মঞ্চের উপর এক বৃদ্ধ প্রবীণ শিক্ষকের হাতে দুই( দৃশ্যমান দুই, কিন্তু বিবৃতিতে আরো দুই) শিশু শিক্ষার্থীকে গলা টিপে মেরে ফেলা দেখতে বাধ্য করেছে। বিকলাঙ্গ নাটক আমাদের তা-ই, নিষ্ঠুরতার নিষ্ঠাবান জয়যাত্রা দেখে, ভেবে, বুঝে উঠে, নিজেদের বাস্তব ভারসাম্য রক্ষা করায় অন্য এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে নিয়ে যায়? আমাদের সমাজ, আমাদের বাস্তবতা বোধ, আমাদের রাজনৈতিক চেতনা, আমাদের শ্বাশত জ্ঞান, আমাদের বাঁচা-মরার ঠুনকো অবস্থান দেখায়।

নাটককার শান্তনু মজুমদার এই নাটকের রচয়িতা। যিনি আজীবন প্রগতিশীল নাটকের সার্থক সৃজক। যিনি রাজনৈতিক বোধে উদ্ভাসিত এমন এক গল্পকার-কাম নাট্যকার। সাহিত্যে যে নাটক উজ্জ্বলতা পায়। পেয়ে আসছে। যার নাটকের মস্ত সম্মান গল্পের গতিপ্রকৃতির বাঁক ফিরে শোয়া। নদীর মতো চলা। তারপর লাফিয়ে বলা আমি আছি আমাতেই। আমি জ্যান্ত আঘাতেই। তিনি, সেই শান্তনু মজুমদার, আজও বাংলা নাট্য মঞ্চে ছোট নাটকে এক বিচিত্র বাতাস হয়ে আছেন। যে বাতাসে অক্সিজেনের অভাবে কতটা যন্ত্রণা পেয়ে তিনি শেক্সপিয়ারকে আবাহনে ডেকেছেন। প্রথা বিরুদ্ধ, এমন এক স্বকীয় রচনার উদ্ভাবনে আনলেন অনিবার্য ফাঁসি। হত্যার আগুন ঝলকানি। আমাদের অনেকদিন তা-ই ভাবতে হতে পারে। কেন না তাঁর এই ক্রুর কূটিল কৌটিল্য চিন্তায় আজ অবরুদ্ধ হয়েছে সার্বিক চেতনার পতন। বাতাসে বারুদের গন্ধ পেয়ে যিনি মুক্তির উপায় বাতলে দিতে পারতেন। কেন তাঁর এই মরন মরন খেলা। সোনার মাছি খুন করেছি…. বল কী বলবি সময়, ভাল বলে কিছু কী আছে? এই বেপরোয়া দুষ্ট প্রকৃতির রূপ নিয়েই নাটকের ভিন্ন চলন। আর সেই অভিঘাত, যা চাক্ষুষ করে জীবন এর চেয়ে মৃত্যুকেই স্বাগত জানানো হয়ে যায়। হঠাৎ এমন উদ্ভাবনের মধ্যেই এজ পাঠ্যক্রম নেগেটিভ হয়ে আছে। পজেটিভ আরোপিত আহ্লাদিত নাটকের রমরমা বিলাসের বাইরে বিকলাঙ্গ বিকল গাড়ির অন্ধকারে ছুটে চলা। হয়তো আলো জ্বালাবার শেষ জ্বালানি আনতে যাওয়ার উপক্রম। কাজেই মেনে নিতে হয় কতটা মরে গেলে এই নাশকতার উদ্দ্যেশ্যে কোন রচনার গল্প রক্তাক্ত স্বাদ পেতে মেতে ওঠে মরিয়া চাওয়ায়। সময়ের উক্তিতে দেওয়ালে পীঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা অবশ্যই আছে। এই অবসাদজনিত হতাশা নিশ্চিতই সমাজ জীবনের দেওয়ালে বট পাকুড়ের চুন সুরকি সিমেন্ট গেলার গোলামী আস্বাদ কী একেবারেই পেয়ে গেল???? আর তবে পথ কী? এখানে জিজ্ঞাসায় ভরিয়ে দিতেই আমাদের বিরোধ বিপ্লবকে আমরাই কী গলা টিপে মারছি না?

দক্ষিণী থিয়েটার দল এই নাটকের প্রযোজক। নাটক এবং চালনায় শান্তনু মজুমদার। জগন্নাথ স্যারের চরিত্রে শান্তনু মজুমদার নিজে অভিনয়ও করেছেন। বড্ড সহজ সরল স্বাভাবিক অভিনয় তিনি করেন। এবারেও এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র তেমনই আছে। তবে এই মালটিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার আক্রান্তের প্রসঙ্গে, চরিত্রটির আরো গবেষণা দরকার আছে। ব্যাপারটা যখন হত্যায় মগ্ন হবেই তখন সত্তাগত অস্বাভাবিকতা, বা আত্ম মগ্নতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তার চুল চেরা বিশ্লেষণ করতে হতে পারে। ঘটনার আনুপূর্বিক  বলাতে দ্বান্দ্বিক ভাবে মেঘ সূর্যের খেলা অকস্মাৎ আর্বিভাব হয়ে এলে কেমন হয়, ভেবে দেখা যেতে পারে। অন্যান্য চরিত্রে কেউ মন্দ নন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ -কৌশিক তুতুন দাস, এম এল এ শুভ্রকান্তি দত্ত এবং আই পি এস রজত গুপ্ত, এই দুই চরিত্রে দেবব্রত মজুমদার, পিংকু, গাব্বু ও বাচ্চা চরিত্রে উজান হাইত, মা-সৃষ্টি প্রামানিক, বাবা ও কনস্টেবল- পিটার মৌলিক, চিফ ডিসিপ্লিন অফিসার- রাজকুমার হাইত, ওয়াড্রন- কমল মন্ডল, এ ডি ও- রাজেশ বণিক প্রমুখেরা সকলেই নিজেদের সামর্থ্য মত চেষ্টা করেছেন। এই নাটকের আলো নিমাই দাস, আবহ সম্বল সেনগুপ্ত, মঞ্চ শান্তনু মজুমদার খুব সাধারণ চিন্তায় নাটকটিকে সাজিয়েছেন। তবে আলো নিয়ে মঞ্চে আলো ছায়ার আরো কিছু খেলা দেখার বাসনা রইলো। এই নাটক মরন মারন খেলায় জীবন যাপনের সুস্থতা চেয়েছে পতন দেখিয়ে উত্থান উদ্দীপনা যাতে শুদ্ধতা পায়, তার জন্যে। ইতিমধ্যেই ২৮/২৯ টি প্রদর্শন হয়ে গেছে। বহুল মঞ্চায়ন নিশ্চিতই হবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular