সুব্রত কাঞ্জিলাল
পর্দা সরে গেল।
মহাভারত এর যুগ। পুরুষ বেশে চিত্রাঙ্গদা অন্য পুরুষের সঙ্গে তরোয়াল বাজি করছে। ভয়ংকর সেই খেলা। আড়াল থেকে অর্জুনকে আসতে দেখা যাবে। সে এখন ছদ্মবেশে রয়েছে। চিত্রাঙ্গদার তরোয়ালবাজি দেখে প্রশংসায় উচ্ছল হয়ে উঠবে। থমকে যাবে চিত্রাঙ্গদা।
অর্জুন।। চমৎকার। অপূর্ব। ধন্য তোমাদের অস্ত্রশিক্ষা। কে তোমরা? কি পরিচয় তোমাদের? কোন গুরুর কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছ তোমরা?
চিত্রাঙ্গদা।। তার আগে আপনি বলুন, আপনি কে? কোথা থেকে আগমন আপনার? আমাদের রাজ্যে আগমনের হেতু?
অর্জুন।। বলছি। সব বলব। কৌতূহল হচ্ছে তুমি নারী না পুরুষ? তোমাদের গুরুর নাম কি? নাকি একলব্যর মত তোমরাও
চিত্রাঙ্গদার সঙ্গী।। এতসব কৌতুহলের কারণ?
অর্জুন।। সুদূর হস্তিনাপুর থেকে অনেক রাজ্য ঘন জঙ্গল, জনপদ, পাহাড়- পর্বত নদনদী অতিক্রম করে এখানে এসে সবচেয়ে বড় বিস্ময় আমাকে কৌতু হলি করে তুলেছে। অরণ্য সংকুল এইরকম একটা রাজ্যে আপনারা যে অস্ত্র বিদ্যার পরিচয় রাখলেন, এটাতে আমি মুগ্ধ। অনেক ক্ষত্রিয় বীর দেখেছি। আমাদের আর্যাবর্তে ধনুর ধর, ওশি চালনায়, কিংবা গদাযুদ্ধে পারংগম বীরদের অভাব নেই। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, ওশি বিদ্যায় সুদক্ষ একজন শিল্পীকে।
চিত্রাঙ্গদার সঙ্গী।। যদি বলি, আপনার পরিচয় না জানা পর্যন্ত আপনার কৌতূহল নিবারিত হবে না।
অর্জুন।। বেশ। তাহলে আমার পরিচয় জ্ঞাপন করছি। আমি পাণ্ডব পুত্র অর্জুন। বর্তমানে ছদ্মবেশ ধারণ করে রয়েছি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সম্ভবত আসন্ন। সেই কারণে বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে বন্ধু জোগাড় করতে বেরিয়ে পড়েছি। যারা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আমাদের পক্ষে অংশগ্রহণ করে হস্তিনার সিংহাসন থেকে কৌরবদের বিতাড়িত করতে সাহায্য করবে।
চিত্রাঙ্গদা।। আপনাকে স্বাগতম। আমাদের মনিপুর রাজ্যের মহারাজের পক্ষ থেকে, এবং মনিপুর রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের পক্ষ থেকে বীরশ্রেষ্ঠ তৃতীয় পাণ্ডবকে আমাদের অতিথি হবার জন্য আমন্ত্রণ করছি। আপনি আতিথ্য গ্রহণ করে আমাদের সম্মানিত করবেন।
অর্জুন।। আমি আপনাদের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। আরেকটি প্রশ্ন আমার। মনিপুর রাজ্যের রাজার একমাত্র সন্তান তিনি কি আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন? যাকে সবাই একজন পুরুষ পরিচয়ে বিশ্বাস করে।
সঙ্গী।। আপনার অনুমান সত্য। নারী হয়েও আপনার সামনে এদেশের রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদা দাঁড়িয়ে আছেন।
অর্জুন।। ধন্য ধন্য ধন্য চিত্রাঙ্গদা। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে দুর্লভ মানুষ আপনি। আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি, এই সুন্দর দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে যেসব নারী জন্ম নিয়েছে তারা শুধুমাত্র নারী নয়। পরিপূর্ণ মানুষ। কোনরকম ভূমিকা না করে, ভনিতা না করে আমি প্রথমত আপনার কাছে, এবং একইসঙ্গে এই দেশের মহারাজার কাছে একটি বাসনা নিবেদন করতে চাই।
সঙ্গী।। কি সেই বাসনা? অসংকোচে প্রকাশ করুন।
অর্জুন।। এই দেশের সঙ্গে, এই দেশের মানুষের সঙ্গে, এই দেশের সমাজের সঙ্গে, আত্মীয়তা গড়ে তুলতে চাই। বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে চাই।
সঙ্গী।। এটাতো আমাদের সৌভাগ্য। আমার বিশ্বাস আমাদের মহারাজা এককথায় আপনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদা।
চিত্রাঙ্গদা।। আমরা শান্তি প্রিয় জাতি। আমরা বৈরিতায় বিশ্বাস করিনা। আমরা বন্ধুতা চাই। তবে কোনোভাবেই বশ্যতা নয়। সমমর্যাদা প্রত্যাশা করি। হস্তিনার পাণ্ডব বংশের মতো মহান বংশের সঙ্গে চিরস্থায়ী আত্মীয়তা আমাদেরও কাম্য। কিন্তু বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন কি পারবেন শরীর মনে একজন নারী হলেও বাহ্যিক আচরণে একজন পুরুষ সুলভ ব্যক্তিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে?
অর্জুন।। আমাদের গুরু দ্রোণাচার্যের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেও বলছি, একটু আগে আমি যা দেখলাম, আমার মনে হচ্ছে এখনো আমার অস্ত্রশিক্ষার পাঠ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। দেবী চিত্রাঙ্গদাকে গুরু হিসেবে বরণ করে নিতে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আপনি কি পারবেন আমাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে?
সঙ্গী।।(হাসবে) এবার জবাব দেবার পালা তোমার চিত্রাঙ্গদা। আমি মহারাজের কাছে ছুটলাম। তার কাছে এই মান্যবর অতিথির আগমন বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। সেই অবকাশে আপনারা দুজন ভাব বিনিময় করে, দুজনের মনের কথা আদান প্রদান করে নিশ্চিত হন (প্রস্থান)
এবার চলবে চিত্রাঙ্গদা ও অর্জুনের মধ্যে প্রেমের অভিনয়।
সূত্রধর।। এই ছিল মহাভারতের যুগের চিত্রাঙ্গদার গল্প। সেযুগে মণিপুরের রাজা থেকে শুরু করে সমস্ত প্রজা বীর অর্জুনকে নিকট আত্মীয়ের বন্ধনে গ্রহণ করে নিয়েছিল। মনিপুরের সঙ্গে হস্তিনার নিবিড় বন্ধনের সূত্রপাত সেই থেকে শুরু।
চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে অর্জুনের প্রণয় পর্ব এবং বিবাহ পর্ব এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই মিলনের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছিল আর এক বীর অর্জুন এবং চিত্রাঙ্গ দার সন্তান বভরু বাহন। (নেপথ্য কন্ঠের মধ্যে অর্জুন এবং চিত্রাঙ্গদার প্রেম পর্বের অভিনয় চলবে।) (চলবে বিবাহ অনুষ্ঠান। সে যুগের রিচুয়াল প্রদর্শিত হবে। নাচ-গান ইত্যাদি আসবে।)
সূত্রধর।। মহাভারতের যুগ অনেকদিন আগে শেষ হয়ে গেছে। শত শত বছর পার হয়ে গেছে এই উপমহাদেশের নানা রকম রাজনৈতিক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। আধুনিক ভারতের স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গ হয়ে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো র রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনন্দদায়ক নয়। ওই সব অঞ্চলের মানুষগুলোর মধ্যে বা সমাজের মধ্যে নারীর যে উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল, মহিমান্বিত
সামাজিক ইতিহাস ছিল, আজ তা ভুলুন্ঠিত। চিত্রাঙ্গদারা ক্রমাগত হারিয়ে যেতে থাকলো। গোলাগুলি মৃত্যুর আর্তনাদ পুলিশের অত্যাচার ইত্যাদি শব্দের মধ্য দিয়ে নাটকের নতুন দৃশ্য শুরু হবে। চারিদিকে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনের মধ্য দিয়ে একটি অর্ধনগ্ন যুবতী মেয়েকে শৃঙ্খলিত করে কয়েকজন পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে এলো। মেয়েটাকে একটা উঁচু ঢিবির ওপরে শুইয়ে দেওয়া হবে। তারপর পুলিশ গুলোর উল্লাস শুরু হবে। বোতল বার করে মদ খাওয়া। সিগারেট ধরানো। মোবাইল খুলে মিউজিক চালিয়ে নাচ শুরু হবে। মাঝে মাঝে মেয়েটার গায়ে মদ ঢেলে দেওয়া হবে। সিগারেটের ছাকা লাগানো হবে। মেয়েটির মুখ বাধা।
সে শব্দ করতে পারছে না । সমস্ত শরীরে যন্ত্রনা। অত্যাচারিত মেয়েটি তবুও প্রতিরোধ করবার চেষ্টা করবে। কিন্তু বিফল হবে। পুলিশগুলো একে একে তাকে ধর্ষণ করবে। দুজন যুবক দু দিক থেকে আক্রমণ করলে, পুলিশ গুলো পালাবে। আকাশে মেঘ গর্জন করছে। বৃষ্টি হবে। যুবক দুটো একটা কাপড় দিয়ে মেয়েটার শরীর ঢেকে দেবে। মেয়েটি তখন চিৎকার করে উঠবে।
মেয়েটা।। চাইনা। চাইনা কোন আবরণ। চাইনা তোমাদের ভিক্ষার দান। দেশ দেখুক। সমাজ দেখুক। পৃথিবী দেখুক। আমরা মনোরমার মেয়ে। আমাদের লজ্জা নিবারণের কোন উপায় নেই। দেশ আমাদের লজ্জা কেড়ে নিয়েছে। নগ্ন করেছে আমাদের শরীর। নগ্ন তাই এখন আমাদের পরিচয়। আমরা মনোরোমার মেয়ে। আজ থেকে আমরা মনোরমার মেয়েরা উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াবো। আমরা গর্ভে ধারণ করব না পুরুষের উত্তরাধিকার।
মেয়েটা যখন উঠে দাঁড়াবে তার উলঙ্গ শরীরে রক্ত আর বৃষ্টি র জল চুয়ে চুয়ে পড়ছে।
অন্ধকার মঞ্চে প্রতিধ্বনিত হবে——–শত শত নারী কন্ঠ।
আমরা মনোরমার মেয়ে। দেশ আমাদের নগ্ন করেছে। লজ্জা কেড়ে নিয়েছে।
পর্দায় প্রতিফলিত হবে একদল উলঙ্গ নারীর মিছিল।
সূত্রধর আসবে।
সূত্রধর।। এই সেই দেশ যার নাম মনিপুর। মনির দেশ। মনি মানে দুর্লভ রত্ন রাজি। অপূর্ব এই দেশ ভ্রমন করলে বোঝা যায়, সন্ধান পাওয়া যায় রাশি রাশি দুর্লভ রত্ন রাজি। সবুজ বনানী প্রান্তরের পর প্রান্তর যেন উচ্ছল যৌবন। পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট ছোট নদী জীবনের তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে বয়ে চলেছে। অরণ্য এখানে ভয়ংকর নয়। সবুজ অরণ্যের রূপ এখানে উদ্ভিন্ন যৌবনা নারীর মতো। ছোট্ট এই দেশের রাজার একমাত্র কন্যা চিত্রাঙ্গদা কে দেখে বীর অর্জুন সেদিন ভালোবেসে ফেলেছিল তাকে চিত্রাঙ্গদার বাইরের আবরণে পুরুষের বেশ। পুরুষের কাঠিন্য। কিন্তু অন্তরে কোমল নারী। অনন্ত ভালোবাসার ফল্গু ধারা। অর্জুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল চিত্রাঙ্গদাকে। তাদের একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। তার নাম ভ্রূ বাহন। যুগে যুগে এইভাবে বাইরের জগত থেকে অনেক পুরুষ একইভাবে এখানে এসেছে। সুদূর চীন দেশ থেকে পদব্রজে নালন্দা যাওয়ার পথে এসেছিলেন হিউয়েন সাং। এসেছিলেন ফাহিয়েন। এই পথ দিয়ে ই এদেশের অতীশ দীপঙ্কর জ্ঞান তৃষ্ণার কারণে চীন দেশে পৌঁছেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করবার জন্য হাজার হাজার বছর ধরে কত সন্ন্যাসী এই পথ দিয়ে চীন জাপান গিয়েছিলেন।!? প্রেমের বন্ধনে বাধা পড়ে গেছে বৈষ্ণব সম্প্রদায়। কৃষ্ণ প্রেমে বিহবল এই রাজ্যের আকাশ বাতাস। খোল করতাল মৃদঙ্গের সুরে সু রে মথিত হয়। কত যে ইতিহাসের সাক্ষী এই ছোট্ট মনিপুর। বারবার এরা কুৎসিত রাজনীতির শিকার হয়েছে। তবুও এরা নিজস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য থেকে বিস্তৃত হয়নি। এখানকার মাটি মানুষ। মনিপুরী নৃত্য বিশ্ব জয় করেছে গুরু বিপিন সিংহ আর তার স্ত্রী কলাবতী দেবীর উদ্যোগে।
এবার মঞ্চে আসবে মনিপুরী নাচের দৃশ্য। তরুণ যুবক যুবতীদের প্রেমের উৎসব।
একটি মেয়েকে দেখা যাবে পুরুষের পোশাক পরে নাচছিল। তাকে এক যুবক আড়ালে টেনে নিয়ে যাবে।
যুবক।। আজকের দিনেও তুমি এই পোশাক পড়ে এসেছো!!!
যুবতী।। তাতে কি হয়েছে? আমি তো ছোটবেলা থেকে এই পোশাকে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। আমার বাবা-মা আপত্তি করে না। তারাও তো চায় আমাকে এইভাবে দেখতে।
যুবক।। তুমি কেন বুঝতে পারছ না যে, আজকের দিনটা আমাদের একটা জাতীয় উৎসব। সবাই কেমন জাতীয় পোশাক পরে এসেছে। মেয়েরাও জাতীয় এই উৎসবে ট্রাডিশনাল পোশাক পরে।
যুবতী।। আমার এই পোশাকটা ভালো লাগে। এটা পড়লে আমার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি জেগে ওঠে। চিত্রাঙ্গার মত। এই পোশাক আমাকে চিত্রাঙ্গদা হতে শেখায়।
যুবক।। চিত্রাঙ্গদা মনে মনে পুরুষ ছিল না। দেহমনে একজন নারী ছিল। আর সেই কারণেই অর্জুনকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। সন্তানের মা হয়েছিল। তুমি কি অন্যরকম কিছু ভাবছো?
যুবতী।। ঠিক তাই। আমি অন্য রকম কিছু ভাবছি।
আমি মেয়ে মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই না। আমি সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে চাই।
যুবক।। তার জন্য পুরুষের পোশাক পরবার কি দরকার? আমাদের দেশের যেসব মেয়েরা স্কুল-কলেজে যায়, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়, তারা কি সব সময় পুরুষের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়? তারা কি বিয়ে করে না? ঘর সংসার করে না? মা হয় না?
যুবতী।। ওদের সঙ্গে আমাকে মেলাতে চাইছো কেন? আমি তো ওদের মতো হয়ে উঠতে চাই না।
যুবক।। তাহলে তুমি কি চাও? পুরুষের ভালোবাসা তোমার দরকার নেই?
যুবতী।। নারীর জীবনে পুরুষের ভালবাসা একমাত্র
ঐশ্বর্য এটা আমি বিশ্বাস করিনা। পুরুষ ছাড়া একজন নারী অসম্পূর্ণ, এ কথাও আমি ভাবতে চাই না।
যুবক।। তারমানে তুমি মানে তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন অনিবার্য নয়।
যুবতী।। একজন সাধারণ পুরুষ হিসেবে আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই না। আমার জীবনে তোমার প্রয়োজন একজন মানুষ হিসেবে আমি প্রত্যাশা করি।
যুবক।। কথাটা স্পষ্ট করে বলবার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
যুবতী।। আরও স্পষ্ট করে কিছু কথা তোমাকে বলতে চাই। আমি পুরুষের সমান অধিকার অর্জন করতে চাই। তুমি কেন ভুল করছ যে, আমাদের দেশে নারীরা কোনদিন পর্দা নসিন ছিল না। তুমি বিদেশী পুরুষ। অনেকটা মহাভারতের অর্জুনের মত। সেই কারণেই তুমি দেখতে পাও না ,অধিকাংশ বাজার হাটে দোকানে মেয়েরাই তো প্রধান বিক্রেতা হয়ে কাজ করে। যুদ্ধের সময় পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে। এদেশে পুরুষেরা কোনদিন নারীদের অবলা বলে অবজ্ঞা করেনি। তাছাড়া আরও একটি কথা তোমাকে বলতে হবে। জানিনা তুমি বুঝতে পারবে কিনা। যে সংকটের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, এই সময় শুধুমাত্র আঁতুড় ঘর এবং রান্নাঘর সামলে রাখার জন্য আমরা যদি সময় নষ্ট করি, তাহলে আমাদের দেশ এবং জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর ঠিক এই কারণেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, কোন পুরুষকে আমি স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবো না।
যুবক।। তাহলে এতদিন আমাকে মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়েছো?
যুবতী।। আমরা প্রলভন দেখাই না। মহাভারতের যুগের চিত্রাঙ্গদার মত মাঝে মাঝে ভুল করে ফেলি।
যুবক।। ভুল করে ফেলো। আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ভুলের নামান্তর?
যুবতী।। চিত্রাঙ্গদার ভুলের ইতিহাস আমি মুছে ফেলতে চাই।
যুবক।। কি যা তা বলছো তুমি—–! চিত্রাঙ্গদা কি ভুল করেছিল?
যুবতী।। চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে চিনতে ভুল করেছিল।
যুবক।। এসব কি বলছো?
যুবতী।। ঠিকই বলছি। অর্জুন কোনদিন চিত্রাঙ্গদাকে ভালবাসে নি। অর্জুন চিত্রাঙ্গদা কে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করেছিল। আর সেই কারণেই ভালোবাসার অভিনয় করে চিত্রাঙ্গদাকে গর্ভবতী করে হস্তি নায় ফিরে গিয়েছিল। রাজা দুশ্ মনতোর মত ভুলে গিয়েছিলেন তার বিবাহিতা স্ত্রী শকুন্তলাকে। অর্জুনের আসল উদ্দেশ্য ছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মনিপুরের সমর্থন আদায় করা। মণিপুরের সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করা।
যুবক।। আমি মানতে পারলাম না। ভুল ব্যাখ্যা করছো তুমি।
যুবতী।। তার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো, যুদ্ধের পর হস্তিনার সিংহাসন দখল করে পাণ্ডবরা রাজসুও যজ্ঞ করেছিল। তারপর সেই যজ্ঞের ঘোড়া ছুটি এ দিয়েছিল দেশের প্রান্তে প্রান্তে। সেই ঘোড়া এসে মণিপুরে বন্দী হয়। চিত্রাঙ্গদার সন্তান সেই ঘোড়াকে বন্দী করে রাখে। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অর্জুনের পরাজয় হয়। আশ্চর্য ঘটনা এই, চিত্রাঙ্গদাকে গর্ভবতী করে এই দেশ থেকে পালিয়ে যাবার পর আর কোনদিন অর্জুনের মনে পড়েনি চিত্রাঙ্গার কথা। একবারের জন্য খোঁজ করেনি তার সন্তানকে। সবটাই ছিল রাজনীতি। এরমধ্যে ভালোবাসা কোথায়?
যুবক।। তোমার এই নতুন ব্যাখ্যা শুনে আমি স্তম্ভিত। হতাশ। বাকরুদ্ধ। একটা কথাই মনে পড়ছে, সে যুগের চিত্রাঙ্গদারা ভালবাসতে পারতো। আর এ যুগের তোমরা।
যুবতী।। পুরুষের ভালোবাসার রাজনীতিকে চিনতে পেরেছি। তাই বুঝতে পারি, শুধুমাত্র নারী হয়ে তোমাদের যৌন লালসার শিকার হতে চাই না। আমার দেশটাকে হস্তিনাপুরের ক্রীতদাস করতে চাই না। অর্জুনদের
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ময়দানে মনিপুর রাজ্যের বৃথা রক্তপাত ঘটতে দেব না।
যুবকটি রাগে ক্ষোভ চিৎকার করে ওঠে
যুবক।। তাহলে ধ্বংস হও। তোমাদের ঔদ্ধত্যের পতন ঘটুক। দেশের নতুন অর্থনীতির যে ইতিহাস লেখা হচ্ছে, সেই অর্থনীতির রথের চাকায় তোমাদের
ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। নতুন দিনের সঙ্গে যারা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনা, সমন্বয়ে ঘটাতে পারেনা, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনা।
মেয়েটি হাসতে থাকে। সেই হাসির মধ্যে ফুটে উঠবে
এক বীরাঙ্গনার ঔজ্জ্বল্য। মেয়েটি নেচে উঠবে। এই নৃত্য যেনো নটরাজের প্রলয় নাচ।
ফেড আউট!
যুবক কন্ঠ।।
এলো ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্য হারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যতার বর্বর লোভে
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষা হীন ক্রন্দনে বাষ্প আকুল অরণ্যপথে।
পঙ্কিল হলো ধুলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে।
দস্যু পায়ের কাটামারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিণ্ড
চির চিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।
সূত্রধর।। আড়াইশো বছর আগে এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকেরা। সামনে খ্রিস্টান যাজকদের বাহিনী। যিশুখ্রিস্টের শান্তির বাণী প্রচার করবার ছল।
পেছনে গোরা পল্টনের দল। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়ে উঠল। ধর্মে ধর্মে সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রদায়ের বিভেদ গড়ে তুলে ছুটিয়ে দিয়েছিল তাদের ঔপনিবেশিক রাজনীতি। সেই রাজনীতির রথচক্রে দেশের গ্রামাঞ্চল, বনাঞ্চল ধ্বংস হতে থাকে। অন্যদিকে শহরে মানুষের জীবনে আসে নতুন আলো। জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো। এইখানে আসবে একদল বিদেশী দস্যুর আক্রমণ। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া। নিরীহ নর-নারীকে খুন করা। দেশটাকে পরাধীন করা। এখানে নেতৃত্ব দেবে খ্রিস্টান পাদ্রীরা। ওরা যীশুর নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। ক্রিশ্চান মিশনারীদের একটা মিছিল দেখা যাবে। বুকে যিশুখ্রিস্ট ের ক্রশ। হাতে মোমবাতি। মুখে শান্তির গান। অঞ্চলের নিরীহ মানুষ অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য দলে দলে পাদ্রি সাহেবের কাছে এসে নতজানুর হবে। আশ্রয়ের জন্য আকুল প্রার্থনা জানাবে। পাদ্রী সাহেব সেইসব মানুষকে বুকে টেনে নেবে।
পুরুষকন্ঠ।। ওরা সভ্য। ওরা মানুষ ধরার দস্যু দল। ওই দলের প্রথমে থাকে খ্রিষ্টান যাজক। ওরা স্বপ্ন দেখায়। ওরা লোভ দেখায়। তারপর ধর্মান্তর ঘটিয়ে চলে। ওদের পেছনে থাকে দস্যু দল। এই ভাবেই ৩০০ বছর আগে চিত্রাঙ্গদার দেশ বিদেশি দস্যুদের দ্বারা পরাধীন হয়ে পড়েছিল। মহাভারতের যুগে অর্জুন যা পারেনি। অর্জুনের বিজয় রথ থমকে গিয়েছিল মনিপুর সীমান্তে। চিত্রাঙ্গদার পুত্র বব্রু বাহন পাণ্ডবদের রাজসুও যজ্ঞের অপ্রতিহত ঘোড়া আটকে দিয়েছিল। চিত্রাঙ্গদার পুত্রের সঙ্গে ভয়ংকর লড়াই হয়ে ছিল অর্জুনের সঙ্গে। সে জানতো না অর্জুন তার পিতা। অর্জুনের পরাজয় ঘটেছিল পুত্রের কাছে। তবে আধুনিক যুগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের হাতে উত্তর পূর্বাঞ্চলের আদিবাসী, ট্রাইবালদের পরাজয় হয়েছিল। সেই থেকে শুরু। তীব্র শোষণ। অমানবিক শাসন। প্রকৃতির সঙ্গে লীন হয়ে থাকা সহজ সরল মানুষদের জীবনে নেমে এসেছিল চিরস্থায়ী অশান্তি। তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ১৯৪৭ সালের পরেও। বাধ্য করা হয়েছিল ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে অঙ্গীভূত হতে। তবুও ওরা নিজেদের নাচ গান সংস্কৃতি চাষাবাদ এসব নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। রতন থিয়ামের থিয়েটার মনিপুরী নাচ দেশের প্রান্তে প্রান্তে, বিদেশের মাটিতে সাংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়েছিল।
তারপর আবার একদল মুখোশ পরা দস্যু, নেমে এলো ওদের মাটিতে।
গাড়ি থেকে নেমে আসা সভ্য মানুষের একটা দল এদিকে ওদিকে চোখে বায়নকুলার লাগিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।
প্রথমজন।। অসাধারণ। আমেজিং। আনএক্সপেটেড। শত শতাব্দি ধরে লোক চক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে কুবেরের সম্পত্তি।
দ্বিতীয় জন।। আমাদের নেতা ঠিকই বলেছেন, লুক ইস্ট। দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল ৭০ বছর ধরে অবহেলার অবজ্ঞার অন্ধকারে মুখ ঢেকে বসে আছে।
তৃতীয় জন।। অথচ এখানে চারিদিকে ছরিয়ে আছে মুঠো মুঠো সোনা। দামি দামি পাথর। মাটির তলায় গলিত সোনার ভান্ডার। এই ভান্ডার যদি উদ্ধার করা যায় তাহলে।
প্রথমজন।। বাধা কোথায়?
তৃতীয় জন।। বাধা আমাদের দূরদৃষ্টি। বাধা আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস। অজ্ঞানতা।
দ্বিতীয় জন।। আপনি কি মনে করেন এখানকার জনজাতি আমাদের বিশ্বাস করবে?
তৃতীয় জন।। এখানকার জনজাতি আমাদের মতন আধুনিক কৃত্রিম সুসভ্য নয়। কিন্তু এরা শান্তিপ্রিয়। এরা ভদ্র। দিল্লি বোম্বাই চেন্নাই কলকাতার মত শহরের মানুষদের সম্মান করে।
প্রথমজন।। কিন্তু অন্তর থেকে বিশ্বাস করে না। এখানকার জনজাতিদের চোখে আমরা হলাম বিদেশি দস্যুদের মত। আর সেই কারণেই তো দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে এরা নিজেদের এখনও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
দ্বিতীয় জন।। আমরা সেই সুযোগ এদের দিয়েছি। এখানে সভ্যতার ইমারত গড়ে তোলার পরিকল্পনা কখনো গ্রহণ করিনি। পাহাড়-পর্বত জঙ্গল ময় এইসব ভূখণ্ডে আধুনিক পৃথিবীর কোন পরিষেবা আমরা চালু করিনি। এখানে কোন ট্রেন লাইন নেই। ইলেকট্রিসিটি ইন্টারনেট শপিং মল, ট্রান্সপোটেশন, রাস্তাঘাট কোন কিছুই তেমনভাবে প্রচলন করা যায়নি।
প্রথম জন।। বাধা আছে বাধা আছে। এখানকার মানুষের মস্তিষ্কের বাধা অতিক্রম করতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে, দিল্লি বোম্বাই চেন্নাই কলকাতার স্বপ্ন। ইউরোপ আমেরিকার আধুনিক পৃথিবীর স্বপ্ন ওদের মস্তিষ্কে ভরে দিতে হবে। ধীরে ধীরে আঘাত আনতে হবে এদের হাজার বছর ধরে চলে আসা সংস্কৃতির ওপর। আদিম বিশ্বাসের উপর। তরুণ সমাজকে ধরুন। যুবক যুবতীদের সামনে মাইকেল জ্যাকসন তুলে ধরুন। ইয়ান কি কালচারের ছবি এখানে প্রচার করতে হবে। মার্কিন জিন্স, স্কচ হুইস্ক আমদানি করতে হবে। ওদের কয়েকজনকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে তুলে নিয়ে যেতে হবে দিল্লী বোম্বাইতে।
তৃতীয়জন।। ওদের বোঝাতে হবে, অরণ্য সাফ করে এখানে আধুনিক শহর তৈরি হবে। 50 /100 তলা বিল্ডিং এর হাইরাইজার উঠবে। শপিং মল হবে। ঝা চকচকে রাস্তা হবে। মেট্রো রেল চলবে। আই নক্সা আসবে। নাইট ক্লাব আসবে। পুরনো পৃথিবীতে পড়ে থাকলে চলবে না। ঢোল করতাল মৃদঙ্গ দিয়ে রাধা কৃষ্ণের প্রেম সংগীত বাসি হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় জন।। আর এইসব করতে গেলে, অরণ্যের অধিকার ছাড়তে হবে। মাটিতে তরল গলিত সোনা রয়েছে, সেগুলো তুলে আনতে হবে। তোমাদের চাকরি হবে। গাড়ি হবে বাড়ি হবে।
প্রথমজন।। তাহলে আর অপেক্ষা কেন? স্বপ্নের ফেরিওয়ালা চলে আসুক উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি জনপদে। এখানে আপনাদের বজরংবলীদের দিয়ে কাজ হবে না। রাম নামের সুরসুরি সেটাও খাওয়ানো যাবে না।
দ্বিতীয় জন।। তবুও কিন্তু বাঁধা আসবে। এদের কুসংস্কারের বাধা। হাজার হাজার বছর ধরে লালন পালন করা বিশ্বাসের বাধা। সরল শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো ——
প্রথমজন।। তখন খাওয়াতে হবে ধর্মের শরবত। ধরাতে হবে জাতিবিদ্বেষের মদ। শুনেছি এখানে গাঁজা উৎপাদনে একটা রেকর্ড রয়েছে। ওই গাঁজা খেত গুলোকে সবার আগে দখল করতে হবে। ওখান থেকে আসবে পেট্রো ডলার।
দ্বিতীয় জন।। দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতে হবে। তবে অন্য কৌশলে। আদালতকে জড়িয়ে দিতে হবে। আদালত ঘোষণা করবে, মেই তেই সম্প্রদায়কে তাপসিলী জনজাতি হিসাবে সরকার মান্যতা দেবে। আর ঠিক তখন অনিবার্যভাবে কুকি সম্প্রদায় মেইতেই সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করবে। বাঁধবে দাঙ্গা। ডিভাইড এন্ড রুল। ভাগ করো তারপর শাসন করো।
তৃতীয় জন।। গ্রামকে গ্রাম বনাঞ্চল থেকে বনাঞ্চল কুকি সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করবার সুযোগ এসে যাবে। তারপর সেই অঞ্চলগুলো কর্পোরেট দের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
ওরা হেসে ওঠে।
ডিভাইড এন্ড রুল—-এই / শব্দটা চতুর্দিকে প্রতিধ্বনিত হয়।
প্রথমজন।। আমি তো দেখতে পাচ্ছি ক্ষেত্র প্রস্তুত। অনেকদিন আগে থেকে এখানে ছোট-বড় নানারকম আগ্নেয়গিরি ঘুমিয়ে আছে। জাগিয়ে দিতে পারলেই
কাজ হাসিল হয়ে যাবে।
তৃতীয় জন।। ঠিক বলেছেন স্যার। এখানকার খ্রিস্টান জন জাতীদের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের নানা রকম অর্থনৈতিক বিরোধ চলে আসছে।
দ্বিতীয় জন।। মেই তেই জনজাতি আর কুকিদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। এটাই পরিষ্কার।
প্রথমজন।। তাহলে অপেক্ষা কেন? একটা সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সরকারি ঘোষণা করে দিলেই হয়।
তৃতীয় জন।। ঠিক বলেছেন স্যার। তাহলেই দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আর সংখ্যালঘুদের মধ্যে লড়াই বাঁধিএ দিয়ে ব্রিটিশরা আমাদের দেশে আড়াইশো বছর শাসন করেছিল। আমাদের ওই পথটাই ধরতে হবে।
শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা।
দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে নানারকম ঝগড়া। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি পাহাড়ি গুহায় দেখা যাবে দুজন যুবক যুবতী কে। এরা প্রশাসনের সঙ্গে লড়াই করছিল।
পুরুষ কন্ঠ।। বিদেশি সংবাদ সংস্থা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যে সংবাদ পরিবেশন করলো তা হল, মনিপুরের খ্রিস্টানদের সঙ্গে হিন্দুদের লড়াই বেঁধেছে।
আর দেশীয় সংবাদ সংস্থা প্রচার করলো, কুকি সম্প্রদায় আর মেই তেই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধেছে। আমরা হয়ে গেলাম অবরুদ্ধ। মাসের পর মাস আমরা সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। পুলিশ মিলিটারি হয়ে পড়ল নিষ্ক্রিয়। শত শত বাড়ি আগুনে ভষ্মভূত হল। শত শত নারী ধর্ষিতা হলো।
শত শত বৃদ্ধ শিশু তরুণ এর রক্তে মাটি লাল হয়ে গেল। প্রশাসন নির্বিকার। দেশের শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া কেন পায় না বিপন্ন মানুষ? সবাই কি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো চোখ বুজে আছে?
নাটক শুরু হবার দৃশ্যের সময়কার সেই মেয়েটা চিত্রাঙ্গদার পোশাকে মঞ্চে আসবে।
নারী।। আমি চিত্রাঙ্গদা। রাজেন্দ্র নন্দিনী।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।
পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি
নই; অবহেলা করি কুশিয়ারা রাখিবে
পিছে, সেও আমি নহি। যদি পাশে রাখো
মোরে সংকটের পথে, দুরু হ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি করো
কঠিন ব্রত এর তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে করো সহচরী,
আমার পাইবে তবে পরিচয়। গর্ভে
আমি ধরেছি যে সন্তান তোমার, যদি
পুত্র হয়, আ শৈশব বীর শিক্ষা দিয়ে
দ্বিতীয় অর্জুন করি তারে একদিন
পাঠাইয়া দিব যবে পিতার চরণে,
তখন জানিবে মোরে, প্রিয়তম।।
আজ শুধু নিবেদি চরণে, আমি চিত্রাঙ্গদা। আমি রাজেন্দ্র নন্দিনী।
এ যুগে আমি, মনিপুর কন্যা মনোরোমার উত্তর পুরুষ। আমারে অবলা করি, আমারে ধর্ষিতা করি, যে অপমান এবং লাঞ্ছনা করিতেছ, তার পরিনাম তুমি কি জেনেছো মনে মনে? দম্ভ তোমার গগন চুম্বি! স্বেচ্ছাচারী তুমি হে শাসক রাষ্ট্র অধিপতি, পুনর্বার স্মরণ করি, আমি চিত্রাঙ্গদা। রাজেন্দ্র নন্দিনী।
একজন কুকি সম্প্রদায়ের যুবক সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে আসবে।
যুবক।। তুমি এখানে শর্মিলা! আমি তোমাকে সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছি!
যুবতী।। আমিও তো তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। লোক মুখে শুনতে পেলাম, তুমি নাকি গোলমাল এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছ। ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে গেছে—-
যুবক।। ঐরকমটা ঘটতে পারত্। তবে ভাগ্য ভালো যে আমি পালাতে পেরেছিলাম। আমার চোখের সামনে
আমাদের সম্প্রদায়ের তিন তিনটে গ্রাম ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
যুবতী।। ওরা কারা? তুমি নিজের চোখে দেখেছো?
যুবক।। দেখেছি। ছোট ম্যাটাডোর করে তিন গাড়ি বোঝা ই গুন্ডার দল গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়াচ্ছে।
যুবতী।। তোমার দেখাটা সত্যি হলেও, বোঝাটা ঠিক নয়। তুমিও তো মনে করছ তোমাদের সম্প্রদায়ের বাইরের লোক ওরা। আসলে কিন্তু ওরা পুলিশের লোক।
যুবক।। কি বলছো তুমি, ওরা পুলিশের লোক!!! কিন্তু আমরা সবাই জানি ওরা মেই তাই সম্প্রদায়ের গুন্ডা।
যুবতী।। এইখানেই তো ভুল হচ্ছে। পুলিশ মিলিটারির কিছু লোকজন গুন্ডাদের দাঙ্গা করার জন্য ব্যবহার করছে। আবার অন্য কোন কোন জায়গায় গুন্ডাদের পুলিশের পোশাক পরিয়ে সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করছে।
যুবক।। তুমি ঠিক বলছো শর্মিল?
যুবতী।। গোপনে বেশ কিছু সাংবাদিক লাইফ রিক্স নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এইসব তথ্য তুলে এনেছে। ওদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এইসব খবর মেনস্ট্রিম মিডিয়া প্রচার করছে না। যেসব ছোট ছোট সোশ্যাল মিডিয়া এইসব খবর তুলে ধরছে, সেইসব সোশ্যাল মিডিয়ার সাংবাদিকদের জেলে পাঠানো হচ্ছে। তাদের মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তবুও গোপনে কিছু তথ্য চিত্র তৈরি হয়েছে। গোপন পথে সেই সব ডকুমেন্টারি ফিল্ম গুলো পৃথিবীর সর্বত্র প্রচার করে দেওয়া হচ্ছে। একটা জিনিস তোমাকে বুঝতে হবে মাই লান, সাধারণ মানুষ দাঙ্গা করে না। সাধারণ মানুষ তুমি আমি শান্তি চাই। এমনিতেই গরিব মানুষগুলো পেটের ভাতের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছুটে বেড়াচ্ছে। দাঙ্গা করবার অবকাশ তাদের কোথায়?
যুবক।। এখন আমাদের কি করতে হবে মনোরমা?
যুবতী।। এখানে যা ঘটছে সেসব বাইরে প্রচার করতে দেওয়া হচ্ছে না। সাংবাদিকদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকেও এখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তিন মাসের বেশি হয়ে গেল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। এখন সময় এসে গেছে মাইলান, আমাদেরও একটা কিছু করতে হবে। দাঙ্গা বন্ধ করতে পথে নামতে হবে।
যুবক।। রাস্তায় তো কারফিউ চলছে। মাসের পর মাস সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ। দলে দলে মার খাওয়া মানুষ উদ্ধার আশ্রম শিবিরে গিয়ে উঠছে। সেখানেও গুন্ডাদের আক্রমণ চলছে। এই আগুন কবে থামবে কে জানে।
যুবতী।। এই আগুন তখনই থামবে যখন আমরা রিফিউজি দের মত আমাদের দেশ ছেড়ে আমাদের অরণ্যের অধিকার ছেড়ে, মাটির তলায় যে সম্পদ আছে সেইসব কর্পোরেট দের কাছে সমর্পণ করে অন্য কোথাও চলে যাই তাহলে শ্মশানের শান্তি ফিরে আসবে।
যুবক।। তাহলে তোমার আবার মিলন কি করে হবে?
যুবতী।। এ জীবনে সম্ভব হবে না। আমাদের দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিষ ঢুকেছে, সেই বিষ আমাদের মিলতে দেবে না। তোমার আমার পরিবার আমাদের মেনে নেবে না। তারা পুরনো সংস্কারে আবদ্ধ। তারা বুঝতে পারছে না যে, আমাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, এটা কর্পোরেট পুঁজি তৈরি করেছে।
যুবক।। চলো আমরা পালিয়ে যাই-
যুবতী।। কোথায়?
যুবক।। অন্য কোথাও। অন্য কোন দেশে। যেখানে দাঙ্গা নেই। হিংসা নেই। হানাহানি নেই। মানুষ মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলে না।
যুবতী।। সেটা কোথায়?
যুবক।। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই রয়েছে। সেই দেশ আমরা খুঁজবো। আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন খুঁজে পাবো।
যুবতী।। স্বার্থপরের মতন পালিয়ে যাব নিজেদের সুখ শান্তি আনন্দের জন্য। তাহলে এই দেশের কি হবে? যে দেশ আমাদের জন্ম দিয়েছে। যে দেশের মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বড় হয়েছি। যে দেশের জলবায়ু প্রতিদিন নিশ্বাসে প্রশ্বাসে বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে জীবনের বৈচিত্র্য খুঁজে পাই, সেই মাতৃভূমিকে অবহেলা করে, কোথায় যাব? এই মাতৃভূমি তো এখন জ্বলছে পুড়ছে। আমার মাকে পুড়তে দেখে আমরা পালিয়ে যাব?
যুবক।। হ্যাঁ যাবো। এই রক্ত আগুন যন্ত্রণা আমি আর দেখতে পারছি না। সহ্য করতে পারছি না। আমি মরতে চাই না শর্মিলা। বাঁচতে চাই। সেটা যদি হয় স্বার্থপরের মত, একা একা বাঁচাও তবুও আমি এখানে আর ফিরতে চাই না। এদেশ এখন দসুর কবলে। এই দেশ এখন মৃত্যু উপত্যকা। এখানে বাতাসে পোড়া মানুষদের গন্ধ ছড়াচ্ছে। এখানে কোন সুস্থ মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে। আমি কোন কথা শুনবো না।
যুবতী।। মাথা খারাপ কোরোনা। এই সময় শান্ত থাকতে হবে। তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে এই দেশকেও তোমাকে ভালবাসতে হবে। আমি আর এই দেশ আলাদা নয়।
যুবক।। তোমার পবিত্র আবেগ আমি সমর্থন করলেও এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে একমত হতে পারছি না। ইরাম শর্মিলা চানুর কথা তোমার মনে আছে? মনিপুরের স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, মাসের পর মাস অনশন করেছিলেন! তারপর তাকে জেলে ভরে দেওয়া হয়! ইরাম শর্মিলা চানুর আন্দোলনের ডাকে সেদিন রাজধানী ইম্ফল এর প্রকাশ্য জন পথে 12 জন নারী উলঙ্গ হয়ে বর্বর অত্যাচারী ইন্ডিয়ান মিলিটারি র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সেই শর্মিলা চানু এখন বলছেন, আমার দেশ এখন আর আমার নেই। ওটা মৃত্য উপত্যকা। ওটা শয়তানদের মৃগয়া ভুমি হয়ে গেছে। ওখানে আমি আর কোনদিন ফিরে যাব না।
যুবতী।। আমার নাম ও শর্মিলা । আমাকেও যদি ওরা নির্যাতন করে। তবুও বলছি, এই মৃত্যু উপত্যকার শহীদদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।
যুবক।। ছেলে মানুষী করো না। আমার কথা শোনো।
যুবতী।। শোনবার আর কিছু নেই। হাজার হাজার বছর পূর্বে অর্জুন রা যে ভাবে আমাদের বঞ্চনা করেছিল, সেই ট্রাডিশন আজও তো চলছে। অর্জুনরা যুগে যুগে নতুন নতুন নাম নিয়ে পোশাক পরে আমাদের কাছে ফিরে আসে। আমাদের ধর্ষণ করে ফিরে যায়। তারপর আর কোনদিন আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। তুমি চলে যাও। চলে যাও তুমি। আমি চিত্রাঙ্গ দার বংশধর। এ যুগের চিত্রাঙ্গদা আর ভুল করতে চায় না।
যুবকটি মেয়েটিকে জোর করে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। আর ঠিক তখনই পুলিশ এবং দাঙ্গাবাজরা এদেরকে আক্রমণ করবে। ছেলেটাকে গুলি করে মারবে। শর্মিলা কে বিড়াল যেভাবে ইঁদুর কে মারে সেইভাবে খেলিয়ে খেলিয়ে ধর্ষণ করবে।
বৃষ্টি নামবে। ধর্ষিতা শর্মিলা রক্তাক্ত অবস্থায় উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করবে।
যুবতী।। আমি চিত্রাঙ্গদা। রাজেন্দ্র নন্দিনী। নহী সামান্য নারী। আমি মনোরমার সন্তান। মনিপুর দুহিতা। অর্জুনপুত্র বব্রু বাহন আমার গর্ভে জন্ম নিয়েছে। আমার সন্তান ও বীর যোদ্ধা। যেন দ্বিতীয় অর্জুন। সেই সন্তান সেদিন পাণ্ডবদের স্বেচ্ছাচার
মনিপুর রাজ্য দখল রিনা যুদ্ধে মেনে নেয় নি। পিতার সঙ্গে তার ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। আমি সেই চিত্রাঙ্গদা, এখন মনোরোমার সন্তান। সেই চিত্রাঙ্গদা এখন আমি নির্যাতিতা। আমি ধর্ষিতা। স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে আমি বারবার ধর্ষিতা হই। আমি যে মনোরমার মেয়ে। আমি জানি আমার সন্তানেরা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। তারা আসবে। একদিন তারা ছুটে আসবে। তাদের মায়ের মুক্তির জন্য। তাদের মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য। আমাকে ততদিন অপেক্ষা করতে হবে। রক্তাক্ত মেয়েটি ছোট্ট একটা তিরঙ্গা পতাকা খুঁজে এনে ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিতে হবে হাজার হাজার নারী মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
পর্দা নেমে আসবে।
বিদ্র – নাট্যকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া এই নাটক অভিনয় করা যাবে না। সেটা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ।