সুব্রত কাঞ্জিলাল
শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব একশত কিংবা তার কিছু বেশি সময় আগে ঘটেছিল। তবে নাটক, নাচ গান ইত্যাদি কয়েক হাজার বছর আগে থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণভাবে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠে ছিল। তারপর এল কাব্য কবিতা, নাটক এবং কথা শিল্প ও চিত্রশিল্প। ছবি আঁকতে প্রয়োজন হয় রং তুলি ক্যানভাস। কথাশিল্পের জন্য কাগজ কালি কলম মন। নাটক পরিবেশন এর জন্য রঙ্গমঞ্চ এবং বহিরঙ্গ। ক্যামেরা আবিষ্কারের পরে বিশেষ করে মুভি ক্যামেরা, শিল্প সৃজনএর দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটে গেল। আমরা দেখলাম চলচ্চিত্র এমন একটা মাধ্যম যাকে বলা হয় কম্পোজিট আর্ট। শিল্প মাধ্যমগুলোর প্রায় সমস্ত কে আত্মস্থ করে ন্যায় চলচ্চিত্র। তাহলে কি একটা ক্যামেরা কে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়? পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এখানে চলচ্চিত্রের আদি যুগে শব্দের ব্যবহার ছিল না। তারপর যখন থেকে শব্দের ব্যবহার শুরু হল চলচ্চিত্রের অসীম শক্তি আমাদের অবাক করে দিল।
ভারতীয় চলচ্চিত্রে সেই সময় দেখা গেল, পৌরাণিক কাহিনী, সামাজিক কাহিনী, ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়ে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে যাকে বলা হলো সেলুলয়েড লিটারেচার। তাহলে কি আমরা সেলুলয়েড লিটারেচারকে বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র শিল্প বলবো?
সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী নির্মাণ করে আমাদের চোখ খুলে দিলেন। বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের রূপ কি হতে পারে এইটা তিনি দেখিয়ে দিলেন। তারপর ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, এবং আরো অনেকে এগিয়ে এলেন। ৩০ এবং ৪০ এর দশকে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব চলচ্চিত্র সৃষ্টি হচ্ছিল, যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সত্যজিৎ রায় প্রমুখরা নিজেদের শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। আয়ত্ত করেছিলেন ক্যামেরার ভাষা। যা কিন্তু চিত্রশিল্পীর রং তুলি, কথাশিল্পীর কালি কলম এবং থিয়েটারের মঞ্চ ভাষার সঙ্গে একেবারেই মেলানো যায় না।
সোভিয়েত রাশিয়ার আইযেনস্টাইন চলচ্চিত্র সম্পাদনার যে দিগন্ত উন্মোচন করলেন, তা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, চলচ্চিত্রের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। নাটক যেমন সংলাপ নির্ভর। চলচ্চিত্রে সংলাপের ভূমিকা গৌণ। এখানে ইমেজ অর্থাৎ দৃশ্য বস্তুর ভূমিকা প্রধান। এক একটি শট এককভাবে যার কোন অর্থ হয় না। একাধিক শট যুক্ত হয়ে এক একটি চিত্র ভাষা গড়ে ওঠে। যেমন শব্দের মালা গাথা র মধ্য দিয়ে কবিতার শরীর গড়ে ওঠে।
সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী ছবিতে ক্যামেরা কে ব্যবহার করে বাংলার গ্রামের দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন। পরবর্তী সময়, রায় বাবু সাহিত্য নির্ভর গল্প ক্যামেরার ভাষা দিয়ে যেভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন তাকে কিন্তু আমরা কোনভাবে সেলুলয়েড লিটারেচার বলতে পারি না।
ঋত্বিক ঘটক এর সিনেমা উপস্থাপিত হলো বিগত দিনের চলচ্চিত্রের ব্যাকরণ কে ভাঙচুর করে। তিনি পেলব, মসৃন, অতি নাটকীয়তা বর্জন করলেন।
মৃণাল সেন (Mrinal Sen) জীবনের শুরুর দিকে আখ্যান বস্তুকে অগ্রাহ্য করতে পারেন নি। তবে বাইশে শ্রাবণ ছবি থেকে তিনি গল্পের বাঁধুনি অগ্রাহ্য করা শুরু করলেন। ভুবন সোম, ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক, আকালের সন্ধানে, কোরাস, জেনেসিস, ছবিগুলোতে ধরা বাধা গল্প অস্বীকার করে এগিয়ে চলেছিলেন। তারপর তাঁর তৃতীয় পর্ব যখন শুরু হল অর্থাৎ একদিন প্রতিদিন, খারিজ, আমার ভুবন, একদিন আচানাক, খন্ডহর, এইসব ছবিগুলোতে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের আখ্যান থাকলেও তিনি সেই আখ্যান নিজের মতো করে ভাঙচুর করে নিয়েছিলেন।
সাহিত্যের ভাষার কাছে তার ক্যামেরা কখনো নতজানু ছিল না। আরো যেটা করলেন, তীব্র নাটকীয়তা কঠোর হাতে বর্জন করলেন। বিশেষ বিশেষ প্রধান চরিত্রের প্রতি কোন রকম দুর্বলতা প্রকাশ করলেন না। তাঁর ছবিতে কখনো ঘটনার ঘনঘটা দেখা যাবে না। সামান্য, দৈনন্দিন জীবন যাপনে এড়িয়ে যাওয়া ছোট ছোট কিছু ঘটনা তার ছবিতে অন্যরকম ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রবল জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে উঠল। যেমন একদিন প্রতিদিন ছবিতে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের রোজগেরে মেয়ে অফিস থেকে বাড়ি না ফেরার ঘটনা নিয়ে সেই পরিবারের একটি রাত্রির টানা পোড়েন চলতে থাকে। চরিত্রের সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্কের অজানা দিকগুলো উলঙ্গ হয়ে ওঠে। ইন্টারভিউ ছবিতে এক বেকার যুবকের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া নিয়ে একদিনের টানাপোড়েন।
প্রশ্ন তুলে দেয় যে, বাংলাদেশে একজন বাঙালি তার জাতীয় পোশাক পরে কেন ইন্টারভিউ দিতে যেতে পারবে না। আকালের সন্ধানে ছবিতেও দেখা গেল গল্পের ভূমিকা নগণ্য। একটা সিনেমা কোম্পানি গ্রাম বাংলার ছবি তুলতে গেছে। ছবির বিষয় চল্লিশের দশকের আকাল। শুটিংয়ের মধ্যে শুটিং দেখতে দেখতে পরিচালকের নির্মহ দৃষ্টি আমাদের সামনে যে সত্যটি উপস্থাপিত করে, তাহল চল্লিশের দশকের আকালের পরেও স্বাধীনতার ৪০ বছর পরবর্তী সময়ে আর এক নতুন আকাল আবিষ্কার করা যাচ্ছে। আকালের পটভূমিকায় সাটের দশকে বাইশে শ্রাবণ ছবি করেছিলেন। এক ট্রেনের হকার যে আলতা ফেরি করে বেড়ায়, তার প্রথম বিবাহ, দাম্পত্য, প্রেম, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়এর আকাল কিভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়। মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষ। নবদম্পতির স্বপ্ন কিভাবে ক্ষুধার আগুনে জ্বলে পুড়ে গেল।
১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ভাষার ছবি ভুবন সোম। এই ছবিটিকে বলা হয় নিও রিয়ালিজম এর ভারতীয় সংস্করণ। সম্ভবত পথের পাঁচালী প্রকাশিত হবার পর ভুবন সোম ভারতীয় চলচ্চিত্র কে আরো একবার উদ্বেল করে দিয়েছিল। চলচ্চিত্র নির্মাণের ভিন্ন ধারার পথপ্রদর্শক এই ছবিটি। আখ্যান ভাগ এখানেও প্রথাগত নয়। কড়া মেজাজের জনৈক রেলওয়ের অফিসার বাবু চলেছেন গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চলের সীমান্তে। উদ্দেশ্য পাখি শিকার। সেই গ্রামের এক গ্রাম্য যুবতীর সংস্পর্শে এসে এই আমলাটির চরিত্রে ঘটে গেল অভাবনীয় পরিবর্তন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ছবিটির বিকল্প বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে কি মৃণাল সেন শিল্পের জন্য শিল্প সৃষ্টি করে গেছেন? তার শিল্পের মধ্য দিয়ে কি বলতে চাইলেন? আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিশ্ব চলচ্চিত্র মহলে মৃণাল সেনকে একজন মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। তার অর্থ এটা নয় যে, আর পাঁচজন মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী শিল্পীর সঙ্গে মৃণাল বাবুকে একই গোত্রে ফেলে দেওয়া যাবে। অনেকে তাকে রাগী পরিচালক বলে থাকেন।
কলকাতার প্রেক্ষাপটে অনেকগুলো ছবি র মধ্যে এই মানুষটার বিদ্রোহী চরিত্র খোঁজার চেষ্টা করেন অনেকে। তিনি কি তাহলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দ্বন্দ মূলক বস্তুবাদের বিশ্লেষক? তথাকথিত শিল্প সমালোচনার প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মৃণাল সেনের শিল্প ভাবনাকে বোঝা যাবে না। তার ছবির চরিত্রগুলো দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণার মুর্ত প্রতীক হয়ে উঠে আসে। বাঁচার জন্য ছবির চরিত্রগুলো লড়াই করে। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়ে সত্তার সঙ্গে যুদ্ধ করে। ইন্টারভিউ ছবির নায়ক চাকরির পরীক্ষার জন্য একটা সাহেবি স্যুট জোগাড় করতে না পারার ব্যর্থতায় বিদ্রোহ করে ওঠে।
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, হতাশ হবার কোন কারণ নেই। এটা কোন পরাজয়ের ঘটনা নয়। পদাতিক ছবির নায়ক ৭০ দশককে মুক্তির দশক ভেবে তার নিজের পিতাকে সুবিধা বাদী ভেবে বসে ছিল। ছবির শেষ মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, মানুষের গণ সংগ্রামের লড়াইয়ের ময়দানে তার বাবা আজও মিছিলে হাটে। সে নিজে গন সংগ্রামের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
আকাশ কুসুম ছবির মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে আসা নায়ক ছবির অন্তিমে বুঝতে পারে, জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার পথ মসৃণ নয়। নিজের শ্রেণী চরিত্রকে আড়াল করে নারীর ভালোবাসা অর্জন করা যায় না। শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি এই পরিচালকের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল না। এই শ্রেণীটা যে আসলে ধান্দাবাজ শ্রেণী, যে কোন মূল্যে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে ফেলতে পারে, একইসঙ্গে বিপদ দেখলে এরা পালায়। আকালের সন্ধানের তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক একই কারণে শুটিং বন্ধ রেখে গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছিল। খন্ড হর ছবিতে ফটোগ্রাফার নায়ক একইভাবে অসহায় এক নারী এবং তার অসুস্থ মা এর সঙ্গে প্রবঞ্জনা করে ফেলে। খারিজ ছবির নায়ক নিজের অপরাধবোধ বুঝতেই পারেনা। তার বাড়ির শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ যে সে এই সত্য ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মৃত শিশুর বাবাকে ঘুষ দেয়।
মৃগয়া ছবিতে তিনি দেখালেন এক আদিবাসী সহজ সরল যুবকের ইংরাজ ম্যাজিস্ট্রেটকে বিশ্বাসের ভয়ংকর পরিণতি। মহা পৃথিবী ছবিটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। ৯ এর দশকে সোভিয়ে ত ভূমিতে সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করলেন এই ছবিতে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে র সদস্যদের নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস, সম্পর্কের জটিলতা। পলাতক নায়কের মায়ের আত্মহত্যার বিবরণ দিলেন পরিচালক। মৃত মায়ের ডায়েরি আগুনে আগুনে সমর্পণ করলেই কি জীবনের গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? বড় নির্মম এই ছবি!!!
১৯৮৪ তে মুক্তির প্রাপ্ত আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবির কথা এখানে আলোচনা করা যেতে পারে। খন্ডাহার। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প অবলম্বনে এই ছবি গড়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষায় এই গল্প নিয়ে আরো একটি ছবি আছে। মৃণাল সেনের এই ছবির ভাষা হিন্দি। সত্যজিৎ রায়ের কাছে হিন্দি এবং ইংরেজিতে ছবি করার অফার এলেও, তিনি গ্রহণ করেন নি। রায় মশাই বলতেন, মাতৃভাষার বাইরে অন্য কোন ভাষায় শিল্পচর্চা করার জন্য যে স্বাচ্ছন্দ বোধ করা দরকার সেটা তিনি পেতেন না। মৃণাল সেন অবশ্য বাংলা হিন্দি উড়িয়া তেলেগু ভাষায় ছবি করেছেন।
শহরের একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার একি গণ্ডগ্রামে ছবি তুলতে এসেছে। ছবি তোলার সাবজেক্ট হলো বাংলার প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য। সেইখানেই একটি প্রাচীন ভগ্নস্তুপ বাড়িতে দুই নারীর সঙ্গে ছবির নায়কের পরিচয় ঘটে। বৃদ্ধ মা অসুস্থ। বিছানায় শয্যা নিয়েছেন। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনছেন। তবুও প্রাণ বেরুতে চায় না। অবিবাহিতা মেয়ের বিয়ে দেখে যেতে চান। একটি যুবক বিয়ে করার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিল। সেই যুবক অনেকদিন হয়ে গেল ফিরে আসছে না। বৃদ্ধ মা ছবির নায়ক ফটোগ্রাফারকে ভুলবশত ভেবে নিয়েছেন যে, সেই যুবকটি ফিরে এসেছে। নাটকীয়ভাবে মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধাকে ফটোগ্রাফার কথা দিতে বাধ্য হন যে, তার মেয়েকে সে বিয়ে করতেই এসেছে। কিন্তু এই মিথ্যাকে সত্যি পরিণত করতে অপারগ গল্পের নায়ক। তাকে শহরে ফিরে যেতে হয়।
শাবানা আজমি, নাসির উদ্দিন শাহ, গীতা সেন, প্রমুখদের অভিনয় চমকে দেয়। অনেকে মনে করেন এই ছবিটা মৃণাল সেনের (Mrinal Sen) শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। মৃণাল সেনের ক্যামেরা এখানে এমন সব অ্যাঙ্গেল থেকে ব্যবহার হয় যা আগে কখনো দেখা যায় নি। সিনেমার সব ব্যাকরণ কে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে ছবি এগিয়ে চলে। অনেকের মনে হয়েছে এই ছবির সম্পাদনাও প্রচলিত সম্পাদনার ধারাকে অস্বীকার করে, নতুন সম্পাদনা রীতি প্রবর্তন করেছে। মৃণাল সেনকে কেন অনেক সময় সত্যজিৎ রায়ের থেকে এগিয়ে রাখা যায় এটাও এইসব ছবি থেকে প্রমাণিত হয়।
বড় কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় এই ছবি। গ্রামের প্রতি শহরের মানুষের অবহেলা, অবজ্ঞা, এবং প্রেম হীনতা মর্মভেদী হয়ে ওঠে। একজন ফটোগ্রাফার ভাঙাচোরা প্রায় অস্বাস্থ্যকর বাড়িতে কিছুদিনের জন্য বসবাস করতে প্রস্তুত। কারণ সে প্রাচীন দেব দেউলের ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে নাম করবে। অর্থ রোজগার করবে। কিন্তু সেই মেয়েটিকে ভালোবাসতে সে পারলো না। কারণ খন্ড হরের মধ্যে জীবনের স্বপ্ন দেখা সেই মেয়েটিকে শহরের ফটোগ্রাফার দয়া করতেও প্রস্তুত নয়। দূর থেকে রোমান্টিক চোখ দিয়ে আমরা গ্রামের নৈসর্গিক চিত্র দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু গ্রামের জীবন্ত মানুষের ভালোবাসা নিজের বুকে স্থাপন করতে পারি না।
এই কারণেই হয়তো অনেকে বলেন, মৃণাল সেনের (Mrinal Sen) ছবিতে পেলবতা যেমন নেই একইভাবে বড় নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দর্শককে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। দর্শককে তিনি কখনো মিথ্যা স্বপ্ন দেখান না। ইচ্ছা পূরণের গল্প তিনি বলেন না। রোমান্টিক ভাবলুতা কে তিনি প্রশ্রয় দেন না। দেশের তথাকথিত স্বাধীনতা কে তিনি জনগণের স্বাধীনতা বলে বিশ্বাস করেন না। তার ছবি তে দেখা যায় স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক শোষণের অস্বাভাবিক তীব্রতা। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্খা গন সংগ্রামের রূপ নিয়েছে। কোরাস ছবিটি এখানে আমরা উল্লেখ করতে পারি।
কলকাতা ৭১, ইন্টারভিউ, পদাতিক এই ছবিগুলোতে গণসংগ্রামের যে রূপ প্রকাশিত হয়েছে তা কিন্তু ভারতের অন্য কোন পরিচালকের ছবিতে বিরল। এক কথায় সিনেমা মানে যে বিনোদন বাণিজ্য এটাকে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। তার ক্যামেরা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার নানা দিকের পোস্টমর্টেম করে গেছেন। ঠিক এই কারণেই তিনি মিষ্টি প্রেমের গল্প বলেন না। তিনি মনে করেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, অর্থনৈতিক অসাম্যের পৃথিবীতে মিষ্টি প্রেমের গল্প দর্শককে মিথ্যা বাস্তবের দিকে পৌঁছে দেবে। ভারতীয় সিনেমা প্রত্যেকদিন কোটি কোটি টাকা খরচা করে এইসব মিথ্যাচার গেলাচ্ছে নিরীহ দর্শকদের।
কেউ কেউ মৃণাল সেনের (Mrinal Sen) সিনেমার বহিরঙ্গ নিয়ে অনেক বেশি কথা বলতে চান। তাদের বক্তব্য এই যে, সিনেমা শিল্পের টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে সত্যজিৎ রায় তেমন ভাবিত ছিলেন না। সত্যজিৎ বাবু কখনো ক্যামেরা কে বেশি গুরুত্ব দিতেন না। অন্যদিকে মৃণাল সেন ক্যামেরা এবং এডিটিং বিষয় অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। জাম্প কা ট, ফ্রিজ শট, মনতাজ ইত্যাদি মৃনাল বাবুর ছবিতে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেভাবে অন্য পরিচালকদের ছবিতে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। ক্যামেরা ও সম্পাদনার বৈচিত্রে বৈশিষ্ট্যে মৃণাল বাবুর সিনেমা অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এইসব মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানতে হবে যে, হলিউডী সিনেমার অনেক বেশি প্রভাব সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে প্রথম থেকেই ছিল। হলিউড মানে টানটান গল্পের উত্তেজনা। নাটকের মত উত্থান পতন ক্লাইম্যাক্স এন্টি ক্লাইম্যাক্স ইত্যাদির প্রয়োগ। অন্যদিকে ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র থেকে। বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ার সিনেমা এই দুই ব্যক্তিকে প্রভাবিত করেছে।
ঋত্বিক ঘটক আবশ্য লুই বুনুএলকে অনেক বেশি মূল্য দিয়েছেন। সত্যজিৎকে প্রভাবিত করেছে বাস্তববাদ। ফরাসি দেশের পরিচালক রেনোয়া আর ইতালির পরিচালক দে শিকা তার মন্ত্রগুরু ছিলেন।
অন্যদিকে পরাবাস্তববাদকে গ্রহণ করেছিলেন মৃণাল বাবুরা। বাস্তবকে বাস্তবের মত করে নয়। বাস্তবকে বাস্তবের মত করে চলচ্চিত্র এবং থিয়েটারে প্রয়োগ করলে এক ধরনের ইলিউশন তৈরি করতে হয়। মিথ্যা বাস্তব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কোনরকম ভ্রম দর্শকের মধ্যে সঞ্চালিত করতে চান না মৃনাল বাবুরা।
সিনেমা ব্যাপারটাকে সিনেমা হিসেবেই দর্শকের কাছে উপস্থিত করতে চান। কারণ এইসব পরিচালকরা ছবির মধ্যে বিতর্কের অবতারণা করে ন। থিয়েটারে যেমন ব্রেখট সাহেব এপিক ফরম প্রয়োগ করেন। বাস্তবকে বাস্তবের মত করে নয়, প্রতিদিনের বাস্তবকে উল্টেপাল্টে দেখাতে চান। মৃণাল বাবু এইভাবে তার ইন্টারভিউ ছবিতে নায়ক রঞ্জিত মল্লিক কে ট্রামের দৃশ্যে সরাসরি ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে বলতে শোনা যায়, ওই দেখুন আমাকে সকাল থেকে একটা ক্যামেরা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ভারতীয় সিনেমাতে এইরকম প্রয়োগ আগে কখনো দেখা যায়নি।
মনে রাখতে হবে, বিষয়বস্তু থেকে আঙ্গিক আলাদা করা যায় না। বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে আঙ্গিকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অথচ আঙ্গিকবাদীরা মৃণাল বাবুর ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহী হন না। যেমন ব্রেখট সাহেবকে তার নাটকের বিষয়বস্তু থেকে আলাদা করে দেখাবার প্রচেষ্টা নিরন্তর।
আকাশ কুসুম ছবিতে অনেকবার ফ্রিজ শট ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা কি বৈচিত্র্যের প্রয়োজনে? যেমন আকালের সন্ধানে ছবিতে জাম্প কাট বেশ কয়েক বার ব্যবহার করেছিলেন। চলচ্চিত্রের পরিভাষায় এইসব শট এর গভীর তাৎপর্য বর্তমান। শক্তিশালী কবি কেমন কবিতায় শব্দ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকেন। একইভাবে চলচ্চিত্রএর পরিচালক কে শ ট নির্বাচন করতে এলোমেলো হয়ে গেলে চলে না। এই লেখা শেষ করবার আগে যে কথাটা বলতেই হবে, ঋত্বিক ঘটক তার সারা জীবন ধরে নাটকে এবং সিনেমাতে বারবার করে দেশভাগের যন্ত্রণার কথা বলে গেছেন। সত্যজিৎ রায় প্রধানত বিশ্ব মানবতার প্রতিনিধি হয়ে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেছিলেন। তবে ৭০এর দশক থেকে এই শিল্পীর শিল্পকর্ম অনেক বেশি রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিল। জীবনের শেষ ছবি আগন্তুক প্রকৃত অর্থে সত্যজিৎ রায় কে চিনে নেবার মতো সবচেয়ে শক্তিশালী ছবি। যদিও সত্যজিতের এই রাজনৈতিক ভাষ্য অনেক নন্দন তাত্তিককে বিমুখ করেছে। তারা বলতেন সত্যজিৎ আর সত্যজিতে নেই।
তবুও এই মহান শিল্পী বারবার নিজেকে ভেঙেছেন। নতুনভাবে গড়ে তুলেছেন। তার নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনৈতিক ছবির নতুন ভাষ্য রচনা করে গেছেন।
অন্যদিকে ঋত্বিক ঘটক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। মৃণাল সেন ও পার্টির অনুগত সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও পার্টির পৈতা গ্রহণ করেন নি। আমরা বলতে পারি ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং সাহসী রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে আমরা মৃণাল সেনকে পেয়েছি। শ্যাম বেনেগাল প্রমূখ দের নাম মাথায় রেখে ও বলা যায়, মৃণাল সেন তার চলচ্চিত্র পরিভাষায় যে রাজনৈতিক ভাষ্য রেখে গেছেন তার তুলনা আপাতত দেখতে পাচ্ছি না। আধুনিক চলচ্চিত্র শিল্পের তিনি প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পী। বর্তমান তো বটেই, ভবিষ্যতে ও এই মহান শিল্পী কে অনুসরণ না করে চলচ্চিত্রের ছাত্ররা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারবেন না।
প্রতিনিয়ত তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। কোরাস, জেনেসিস, পরশুরাম, কাফনছবিগুলোর চলচ্চিত্র ভাষা বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ও খুব বেশি দেখা যাবে না। সত্যজিৎ রায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিনেমা তৈরি করতে গিয়ে অনেক সময় দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা মৃণাল বাবুর মধ্যে এরকম দুর্বলতার পরিচয় তেমনভাবে পাইনা। এটাও এক আশ্চর্যের বিষয়। মৃণাল সেনের সিনেমার বিভিন্ন দিক নিয়ে ইউরোপে আমেরিকাতে যত গুরুত্বপূর্ণ চর্চা হয়, এই দেশে আমাদের বাংলায় এখন পর্যন্ত তার এক শতাংশ দেখা যাচ্ছে না।
বিঃ দ্রঃ আমার এই রচনা কোন নন্দন তাত্ত্বিকদের জন্য নয়।। সিনেমা শিল্পে আগ্রহী তরুণ ছাত্রদের জন্য কয়েকটি কথা বলা হলো। যদিও এর মধ্যে মৃণাল বাবুর সিনেমার সংগীত ও অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা করবার কোন অবকাশ ছিল না। বলাবাহুল্য বর্তমান লেখক অতটা যোগ্য নয়।