নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা
এবার এনএসডি’র গাইড লাইন নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে নতুন ঝামেলায় জড়াল রাজ্য। ঝামেলার বিষয় নাটকের দলগুলিকে কেন্দ্রীয় অনুদান। এরইমধ্যে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী তথা নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু। বলতে গেলে তাঁর খোঁচাতেই এখন বাংলার নাট্যমোদী মানুষদের মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে – মোদির গুণগান না গাইলে তাহলে কি এবার কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ হবে?
ঘটনা হল, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় অনুদানপ্রাপ্ত নাটকের দলগুলির কাছে এনএসডি’র তরফে একটি গাইডলাইন পাঠানো হয়েছে। ব্রাত্য বসুর অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের নির্দেশে এনএসডি বা ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা ওই গাইডলাইন পাঠিয়েছে। যে চিঠিতে নাট্যোৎসবের জন্য যে নাটক তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাতে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে মোদি বন্দনার বিষয় রয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্রাত্য বসু। তাঁর অভিযোগ, বাধ্যতামূলক ভাবে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করেই নাটক তৈরির নির্দেশ দিয়েছে এনএসডি। যা নিয়ে সরব হয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে ব্রাত্য লেখেন, ‘লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটার দলগুলিকে প্রধানমন্ত্রীর মহিমাবাচক, গুণকীর্তন করার একটি ছোট নাটিকা পাঠিয়ে বলেছে, সর্বত্র সেটি মঞ্চস্থ করতে হবে। ওই নাটক মঞ্চস্থ না করলে কেন্দ্রের পাঠানো অনুদান এবং ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
এখানেই থেমে না থেকে রাজ্যের নাট্যদলগুলির উদ্দেশে ব্রাত্য লেখেন, ‘পশ্চিমঙ্গের থিয়েটার দলগুলি যেহেতু মূলত বামপন্থী সেক্যুলার, আমরা আশা করতে পারি যে এই নির্লজ্জ প্রস্তাব সকলে ঘৃণাভর প্রত্যাখ্যান করবেন’। কেন্দ্রের পাঠানো বলে একটি নাটিকাও সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন ব্রাত্য। তিনি লেখেন, ‘ঠেলার নাম বাবাজি কাকে বলে দ্যাখ এবার’।
এখানে বলা ভাল, বাম আমলে এই ব্রাত্য বসুরই নাটক ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ রাজ্য সরকারের রোষানলে পড়েছিল। বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহে সে নাটকের মঞ্চায়ন করতে দেওয়া হয়নি। এরপরেই তৃণমূলে যোগ দেন ব্রাত্য বসু। কালক্রমে তিনি এখন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। সেই সঙ্গে জমিয়ে সিনেমা-থিয়েটারও করছেন। সেই কারণেই হয়তো শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ব্রাত্য বসু কতটা ভালো-খারাপ সে নিয়ে আলোচনার বদলে বরং ‘ব্রাত্যজন’-এ কে যোগ দিলেন আর কাকে তাড়ানো হল – সে নিয়েই চর্চা হয় বেশি।
সম্প্রতি রাজ্য সরকারের আনুকূল্যে কলকাতাতেও নাট্য উৎসব শুরু হয়েছে। তাতে উৎসবের আমন্ত্রণের তালিকায় নাটককারদের নাম না দেওয়া নিয়ে যেমন বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তেমনই যোগ্য বহু নাটকের দলই ডাক পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের নতুন গাইডলাইন নিয়ে চাপান-উতোর তৈরি হওয়ায় নাট্যমহলে আরও একবার ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন রেখা দেখা দিয়েছে। আর সেই ঘোলাজলে মাছ ধরার চেষ্টা করতে দেরি করেননি ব্রাত্য বসু।
মঙ্গলবার টুইট করে ব্রাত্য লেখেন, “কেন্দ্রের বিজেপি সরকার লোকসভা ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গের সবক’টি থিয়েটার দলকে এ দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মহিমাবাচক ও গুণকীর্তন করা একটি ছোট নাটিকা পাঠিয়ে বলেছেন, এর অভিনয় সর্বত্র করতে হবে।” ব্রাত্য এও জানিয়েছেন, যদি অভিনয় না করা হয় তাহলে কেন্দ্রের অনুদান এবং ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হবে।
কেন্দ্রের পাঠানো বলে যে নাটিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন ব্রাত্য, তাতে সূত্রধার এবং এক ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথন খানিকটা এই রূপ-
ব্যক্তি ১: পঞ্চম বেদ কে লিখেছিলেন?
সূত্রধার: আমাদের এক মহান ঋষি, ভরতমুণি। উনি নাট্যশাস্ত্র রচনা করেন। নাটকের অর্থ শৃঙ্খলা, সংগঠন এবং সাক্ষরতা, অর্থাৎ দেশে লেখাপড়া জানা লোক ভর্তি ছিল। তাই তো নালন্দা, তক্ষশিলা, বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই ছিল।
ব্যক্তি ১: এবার বুঝলাম। জ্ঞান ছিল বলেই আমরা ধনী ছিলাম। সোনার পাখি এই জন্যই বলা হতো।
সূত্রধার: বিদেশ থেকে লোকজন এখানে পড়তে আসতেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ব্যক্তি ১: তাহলে গড়বড় হল কবে?
সূত্রধার: ৪০০ বছর আগে।
ব্যক্তি ১: কী করে?
সূত্রধার: একতার অভাবে, অখণ্ডতা ছিল না বলে।
ব্যক্তি ১: তাতেই কি ওই ঐতিহ্য হারালাম আমরা? সামাজিক কুরীতির জন্য?
সূত্রধার: হ্যাঁ।
ব্যক্তি ১: কী কুরীতি?
সূত্রধার: আলস্য, নেশা, অহঙ্কার, বিভেদ, ছুঁৎমার্গ, ভেদাভেদ। নিজেকে অন্যের থেকে বড় ভাবা, নিজেদের মধ্যে লড়াই। প্রত্যেকে এর বিরুদ্ধে সঙ্কল্প নিতে হবে। ব্যক্তি ঠিক হলে, পরিবার মজবুত হবে। পরিবার মজবুত হলে সমাজ এবং দেশও মজবুত হবে।
ব্যক্তি ১: পরিবার বলতে মনে পড়ল, জি-২০ সম্মেলনে মোদিজি ‘ওয়ান আর্থ, ওয়ান ফ্যামিলির কথা বলছিলেন, কেন এমন?
সূত্রধার: এই কথাই তো হাজার হাজার বছর আগে মহা উপনিষদে বলা হয়েছিল, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। অর্থাৎ এক বিশ্ব, এক পরিবার।
ব্যক্তি ১: আমিও কিছু বলতে চাই।
সূত্রধার: কী বলতে চাও?
ব্যক্তি ১: করোনা কালের ব্যাপারে। বিশ্ব জুড়ে করোনার সঙ্কট নেমে এসেছিল। সেই সময় আমাদের ভারতে তৈরি ওষুধ বিনামূল্যে গোটা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, যাতে মানুষের প্রাণরক্ষা হয়েছিল। একেই বলে বাঁচো এবং বাঁচতে দাও।
কথোপথনে বার বার ‘বিকশিত ভারত’, ‘বিশ্বগুরু ভারতে’র উল্লেখও রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে এবং বিজেপি-র রাজনৈতিক সভা-মিছিলে বার বার যার উল্লেখ উঠে এসেছে। তাই এই নাটককে বাধ্যতামূলক করা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ব্রাত্য যেমন কেন্দ্রের এই নির্দেশিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনই বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নির্দেশ এসেছে। কিন্তু আমরা করতে পারব না।” যদিও রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারি এই নির্দেশের পক্ষেই সওয়াল করেছেন।