‘হুব্বা’ ভালো ছবি না কি খারাপ ছবি, নিজে কী মনে করেন পরিচালক ব্রাত্য বসু

- Advertisement -

‘হুব্বা’। আইপিএস সুপ্রতিম সরকারের লেখা ‘আবার গোয়েন্দাপীঠে’র একটি গল্প নিয়েই এই ছবি। পরিচালক ব্রাত্য বসু। একটা সময় ‘হুগলির দাউদ’ বলা হত যাকে, সেই হুব্বা শ্যামলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোশারফ করিম। সিনেমা চরিত্রের নাম বিমল দাস। তাঁর বিপরীতে লালবাজারের দুঁদে গোয়েন্দার ভূমিকায় ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। চরিত্রে যিনি অফিসার দিবাকর।

২৭ পাতার গল্প থেকে ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের ছবি। ছবির সংলাপে মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ‘কাঁচা ভাষা’। বেশিরভাগ সময়েই যা বাংলায় এবং কখনও কখনও অবশ্যই ইংরেজিতে। ১৯ জানুয়ারি ভারত এবং বাংলাদেশ – দুই দেশেই ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। ‘হুব্বা’ রিলিজ করবে নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউ জার্সি, বোস্টন, ভার্জিনিয়া, ডালাস, সান ফ্রান্সিসকোতে। ছবিটি মুক্তি পাবে অস্ট্রেলিয়াতেও।

কিন্তু ‘হুব্বা’ কি সত্যিই বাংলা ছবির নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে? ‘হুব্বা’ কি এমন কাজ করে ফেলেছে যা আগামীদিনে বাঙালি সিনেমায় ইতিহাস হয়ে থাকবে? এমন ছবি কি বাঙালি সংরক্ষণ করে রাখবে? পরিচালক ব্রাত্য বসুর কাছে ‘হুব্বা’ ভালো ছবি না কি খারাপ ছবি? এমনই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ব্রাত্য মিডিয়ায় কী বলছেন দেখে দেখে নেওয়া যাক।

প্রশ্ন – ছবিটা করার পর সাফল্য কেমন ভাবে দেখছেন?

ব্রাত্য – খুব ভালোভাবেই দেখছি। আমার মনে হয় বাংলা ছবির ক্ষেত্রে এটা অনেকেই ভালো ভালো কথা বলছেন। ট্রেন্ডমার্ক ছবি বলছেন, পাথ ব্রেকিং ছবি বলছেন। নতুন জনের ছবি বলছেন। তার থেকেও বড় কথা এতগুলো কন্টিনেন্টে ছবিটা মুক্তি পেয়েছে পাচ্ছে।

বাংলা ছবি নিয়ে বরাবরই আমি চেয়েছি যে হৈ চৈ হোক। বাংলা ছবি যাতে লোকে দেখে এবং কোনও একটা নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে যাতে বাংলা ছবি আটকে না থাকে। তো তার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে যদি ‘হুব্বা’ এমন একটা আলোড়ন এবং প্রভাব তৈরি করতে সমর্থ হয় তাহলে সেটা পরিচালক বা নির্মাতা হিসেবে তো আমার ভালো লাগারই কথা। এর ব্যতিক্রম হবেই বা কেন?

প্রশ্ন – ছবির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ছবি এবং ক্ল্যাসিক্যাল – দুটো ধারা বরাবরই দেখা গিয়েছে। আপনি ঠিক কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ‘হুব্বা’ তৈরি করেছেন?

ব্রাত্য – চার্লি চ্যাপলিনের ছবি নিয়ে আপনি কী বলবেন। চার্লি চ্যাপলিনের ছবি সময় একটা সুপারহিট। এবং তার প্রভাব ১৯২৫ সালে তৈরি ‘দ্য কিড’ ১০০ বছর হতে যাচ্ছে, সেই ছবি দেখলে আজও আমাদের ভালো লাগে। মানে আমি যখন কোয়েন ব্রাদার্সের ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’ দেখি তখন সেটা একই সঙ্গে ভিষণ এন্টারটেইনিং, ছবিটা তার স্পেস ও তার গতি দিয়ে ভিষণভাবে আমাদের গ্রিপ করে রাখে। ওই রকম অসম্ভব অভিনয় এবং ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’-এর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে যে ওখানে কোনও আবহ সংগীত নেই। পুরোটা সাউন্ড দিয়ে তৈরি করা। অথচ ওটা দারুন সিনেমা। একই সঙ্গে গ্রিপিং-চিলিং এবং এন্টারটেইনিং এবং মস্তিষ্কে গিয়ে ধাক্কা মারছে।

এরকম অজস্র সিনেমার কথা আমরা বলতে পারি যেমন এই সম্প্রতি কান ফিল্ম ফ্যাস্টিভলে যে ছবিটা সব ক’টি পুরস্কার একেবারে জিতে নিয়েছে – ‘অ্যানাটমি অফ এ ফল’ ছবিটার নাম। ‘অ্যানাটমি অফ এ ফল’ যদি দেখ তাহলে মনে হবে এটা কি স্বামী-স্ত্রীর গোলযোগের সিনেমা? এটা কি নারীবাদীর সিনেমা? স্বামী-স্ত্রীর যে ভায়োলেন্স সেটা নিয়ে কি এই সিনেমা? না কি এটা একটা সাইকোলোজিক্যাল থ্রিলার? তো আমার মনে হয় যে এখন সিনেমা নির্মাতার প্রধানত যেটা চান যে ভালো ছবি কিংবা খারাপ ছবির বাইরে গিয়ে আমার সিনেমাটা যতক্ষণ লোকে দেখবে যাতে সজাগ মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারে। এবার সেটা ডেনজেল ওয়াশিংটনের ‘দ্য ইকুইলাজার’ও হতে পারে আবার ‘অ্যানাটমি অফ ফল’ও হতে পারে।

আবার ‘অ্যানাটমি অফ ফল’ যে সংখ্যাক দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যাতা তৈরি করে ‘ইকুইলাজার’ কি সেটা করে? উত্তর হচ্ছে না করে না। তার থেকেও বৃহত্তর লোকেদের কাছে যায়। যেটা অনেকটা তামিল ছবি মালায়লম ছবির মূল পার্থক্য। মালায়লম ছবি আমি যখন দেখছি, মামুট্টির একটা সিনেমা আমি দেখছিলাম। একটা সারাক্ষণ স্বপ্নের জগতে চলে যাচ্ছে সিনেমাটা। বিরাট বড় নাম। নামটা এখন মনে পড়ছে না। এখন আমার মনে হয় যে ভালো সিনেমা – খারাপ সিনেমা এভাবেই ব্যাপারটা দেখা উচিত। তার থেকেও বড়কথা যখন দেখতে বসি তখন একবারে সিনেমাটা দেখতে পাচ্ছি কি না। পাওলো ওরিয়েলের ছবি ‘গড ক্রুকড লাইনস’ – যার আগের ছবি থেকে ‘বদলা’ বলে ছবিটা তৈরি হয়েছিল। এই ছবি দেখতে বসলে এই ছবি থ্রিলারও মনে হতে পারে, এটাকে সমাজ নিয়ে একটা বার্তা মনে হতে পারে। ‘গড ক্রুকড লাইনস’ ছবিটা দেখলে মনে হবে যে আসলে গোটা পৃথিবীটাই পাগলা গারদ। অথচ ওটা অদ্ভূত মিস্ট্রি।

তো আমার মনে হয় ছবির নানা রকম ধরন চলে এসছে। এখন আর আমি সিনেমা সংরক্ষণের জন্য বানাচ্ছি – আমি যদি সংরক্ষণের জন্য বানিয়েই থাকি কি গ্যারেন্টি আছে সংরক্ষিত হবেই? কোনও গ্যারেন্টি আছে কি? কোনও গ্যারেন্টি নেই। তো একটা সিনেমা বানাচ্ছি, সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আলোড়ন হচ্ছে, সব কাগজে ভালো লেখালেখি হচ্ছে, ন্যাশনাল স্পেকট্রামে ‘হুব্বা’কে নিয়ে কথা হচ্ছে – আমার কাছে এটাই যথেষ্ট।

প্রশ্ন – আপনি এক জায়গায় ভায়োলেন্সের কথা বললেন। একজন পরিচালকের মধ্যেও হয়তো ইনার ভায়োলেন্স থাকে যা ক্রিয়েট করতে সাহায্য করে। তো আপনার মধ্যেও কি এটা একটা সংশয় কাজ করে? আপনি তো গ্যাংস্টারের ছবি বলছেন, কিন্তু ‘হুব্বা’ তো রাজনৈতিক ছবি? কিভাবে ব্যাপারটাকে দেখছেন?

ব্রাত্য – এখন একটা আমার প্রিয় সিনেমার উদাহরণ দিই। সিনেমাটা হচ্ছে শ্রীরাম রাঘবনের সিনেমা। ‘জনি গদ্দার’ – মানে বেইমান জনি। ‘জনি গদ্দার’ কি একটা শুধু মিস্ট্রি, না কি এই সময়ে যে একটা লুম্পেন, কিছু সম্পূর্ণভাবে মূল্যবোধহীন কিছু মানুষের গল্প যে নিমেষে তার পুরনো বস তাকে গুলি করতে দ্বিধা করে না। যে বন্ধুর কাছে আশ্রিত সেই বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক করতে দ্বিধা করে না। এবং একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে এই লুম্পেনগুলো তারা একটা দৈব নিয়তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যে খেলা সারা সিনেমাটায় চলে। এবং একই সঙ্গে এই মানুষগুলোর অসহায়তা, প্রতারণা – প্রত্যেকটা খুনের আগে একমাত্র যে খুন হচ্ছে সে জানে কে তাকে খুন করছে। আর বাইরে কেউ জানে না। গোটা সিনেমাটায় জানতে পারে না। তারমানে কি পরিচালক নিজে একজন খুনি, নিজে অদৃশ্য থাকতে চান?

কিন্তু আমার মনে হয় শ্রীরাম রাঘবন সিনেমাটার মধ্যে দিয়ে এই সময়, এই যে সমাজ ব্যবস্থা, কতগুলো লুম্পেন লোক, হাতে কাঁচাটাকা এসে যাওয়া লোক এবং কোনও রকম কোনও ভ্যালুসিস্টেম না মানা লোক, এই সব লোকদের উনি মানে এই সময়টাকে উনি ধরতে চেয়েছেন। এবং এরা এক্সিট করছে। এটা নিয়ে কোনও ভালো-মন্দ কোনও লোডেড ভ্যালু দিয়ে দেখলে হবে না। এই লোকগুলো কি ভালো, এই লোকগুলো কি খারাপ ওই ভাবে দেখলে হবে না। ওই লোকগুলো বাস্তব।

সুতরাং ‘হুব্বা’র ক্ষেত্রে – হুব্বা একজন গ্যাংস্টার – তাতে নতুন জেনারেশন তৈরি হল কি না জানিনা। তবে ‘হুব্বা’র মধ্যে বাঙালি জীবনের বেড়ে ওঠা আছে। একই সঙ্গে বাঙালি এলিট জীবনের, একই সঙ্গে বাঙালি সাবঅর্ডার জীবনে – এই দুটো জীবন যখন মুখোমুখি হয় তখন দুটো জীবনই অসহায় ভাবে দেখে যে তাদের মধ্যে কিছু সমান্তরলতা রয়েছে। এই সমাজেই হয়তো দু’জনে টালার জল খেয়ে বড় হচ্ছে, একজন বস্তিতে বড় হচ্ছে একজন পাকা বাড়িতে বড় হচ্ছে। একজনের ছেলে হয়তো বই কেনার পয়সা পায় না আর আরেক জনের ছেলে হয়তো ভালো হরলিক্স খেয়ে সুন্দর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তে যায়। একজন আইপিএস হয়, ডাক্তার হয়। আরেকজন গ্যাংস্টার হয়।

কিন্তু এই সমাজের পাত্র থেকেই এরা উদ্ভুত হচ্ছে। সেখান থেকেই তারা বোরোচ্ছে। এবং তাদের মধ্যে হয়তো কিছু মিল আছে। বেশিটাই অমিল! কিন্তু কিছু মিল তো আছে। সেটাই আমার যে ডিআইজি সিআইডি মানে দিবাকর মিত্র – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত যে পার্টটা করেছেন – এটা তাঁকে হন্ট করে। হুব্বাকে কি করে? মোশারফ করিমকে কি করে? না। করে না। কারণ সে জানে তার উলটোদিকে যে লোকটা বসে আছে, এ ব্যাটা হচ্ছে পাকা সিস্টেম। এ আমাকে ধরতে চায়। আমায় মেরে দিতে চায়। জেলে ভরতে চায়। আমার জন্যে এই লোকটা খতরনাক। বিপজ্জনক। এই খতরনাক লোকের থেকে কিভাবে সে নিজেকে বাঁচাতে পারে – এটাই তার একমাত্র লক্ষ্য।

আমার মনে হয় এই ছবিতে দুই জীবনের বেড়ে ওঠা, ওই একই পাত্রে এবং দু’জনেই যখন মুখোমুখি হয় তখন তাদের জীবন কেমন দাঁড়ায়, একজন তার মাকে তার বাবাকে প্রত্যক্ষভাবে উড়িয়ে দিতে চায়, কম বয়সে সে তার বাবাকে চড় মারে। আর আরেকজন বৃদ্ধ অ্যালজাইমার্স হয়ে যাওয়া মায়ের দায়িত্ব নিতে চায় না। দুজনের মধ্যেই একটা ব্রুটালিটি বেরোয়। এই ব্রুটালিটিটাই পার্ট অফ দ্য সোসাইটি। এটাই বলা যেতে পারে।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -