দেবা রায়
এবারের নাট্যবার্তার মূল উপপাদ্য মৌলিক ভাবনার স্ফুরণ। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি ভাবনা উপস্থাপন করেছে নরওয়ের নাট্যকার ইয়োন ফসে। তাঁর বার্তার ছত্রে ছত্রে আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে শিল্পচর্চাই আগামীর পথকে দৃঢ় করতে পারে।
শবর রায় রচিত কালোব্যাগ নাটকে চায়ের দোকানী কানাই, মধ্যবিত্ত এক ছাপোষা মানুষকে নাট্যের এক বিশেষ মুহুর্তে বলছে- ‘আমাগো মইধ্যে যেটুকু ভালো আছে, সুন্দর আছে, হেগুলারে একত্রিত করতে পারলেই আমাগো জয়, হ্যাগো পরাজয়’- অর্থাৎ আপন অন্তর্নিহিত সুন্দরই শিল্প চর্চার প্রধান উপকরণ। সুন্দরের আরাধনা। বিশ্বব্যাপী নানান বৈচিত্রের মধ্যেই এই সৃষ্টিশীলতা প্রকাশিত থাকে।
দেহ ও মনের যে বৈপরীত্যের প্রসঙ্গ উনি উত্থাপন করেছেন, তার চর্চা ইতিপুর্বে বহির্বিশ্বে শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা এখনও সাবেকী ঘরানার দালান ঘরে অনেক বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করছি। অতীতের সৃষ্টিকে মঞ্চে তুলে এনে থোর বড়ি খাঁড়া, খাঁড়া বড়ি থোরের শিল্পচর্চায় নিজেদেরকে নিযুক্ত করে রাখছি। আভ্যন্তরীণ ভাবনা ও তা প্রকাশ খুব স্বাভাবিকভাবে আসছে না বললেই চলে। যদিও এর বাইরে গিয়ে কেউ চর্চা করছেন না, এমনটা ভাবা বা বলাটা ঠিক হবে না। কিন্তু মূল নাট্যচর্চার অঙ্গনে যা দেখা যাচ্ছে, সেখানে মৌলিক ভাবনার উন্মেষ খুব একটা উঠে আসছে না।
ব্যক্তি মানুষের অভিজ্ঞয়ায় আশ্রিত লেখনী সব সময় নতুনকেই উৎপাদিত করে। অর্থাৎ সম সময়ের ঘটনাবলী যা মানুষের নিজস্ব ভাবনায় ধরা পরে, এবং যা প্রকাশিত হয় তাঁরই একান্ত নিজস্ব কায়দায়। এই মৌলিকত্বের অভাব আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। আমাদের এক্সপেরিমেন্টের টেবিলে রবীন্দ্রনাথ বা শেকশপীয়রকে কাটাকুটি চলে। একদিকে দেশী সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টি ও বিদেশী সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ, যার আসল কারণ নিজেকে নিয়ত প্রতিষ্ঠিত করে যাওয়া একজন শিল্পী বা কর্মী হিসেবে। অথচ, শিল্পীর প্রাথমিক শর্ত কিন্তু তাঁর মৌলিকত্ব।
কপি পেস্টের দুনিয়ায় আজ নতুন ভাবনা আর লেখনীতে কেউ ভরসা করতে পারছি না, কেন? এর বিচার করলে যা বোঝা যাবে, তার আসল কারণ ব্যক্তির দর্শন ও অভ্যাস। একজন শিল্পী তখনই আনন্দ পায়, যখন তার সৃষ্ট কাজ অনেকের থেকে আলাদা হয়ে ওঠে। কিন্তু সারা পৃথিবীতে এক ম্যাকবেথ কত মানুষ করেছেন, যা সকল ক্ষেত্রেই পৃথক। আমি একটা বিদেশী সাহিত্য থেকে একটা গল্পকে যদি আমাদের আবর্তে এনে ফেলি, সেখানে আমাদের সামাজিক অবস্থান ও সংস্কৃতি থাকা কি বাঞ্ছনীয় নয়? কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার উপস্থিতি দেখা যায় না। আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে ৬৭ সালে কি হয়েছিল, এই চর্চার চর্বিত চর্বন করবো? নাকি বর্তমান আর্থ সামাজিক পটভূমিকাকে উপপাদ্য করে নাট্য রচনা ও চর্চা করবো?
আমার মতে শিল্প সদাই মৌলিক। আর যদি সে মৌলিক না হয় তাহলে তার শিল্পে উত্তরণ সম্ভব নয়। নাট্য শিল্পে এক্সপেরিমেন্ট মানে কি? একটা সাবেকী টেক্সট নিয়ে সেটা পথে, অন্তরঙ্গের বিভঙ্গে অভিনয় করা, নাকি প্রথম বিশ্বের চর্চাকে সামনে রেখে নিজেকে অর্থাৎ নিজের ভাবনাকে মেলে ধরা! নিজের ভাবনা মেলে ধরলে আমরা দর্শকের কাছে ভিন্ন রুচির প্রযোজনা দেখাতে পারবো।
আজ যদি হাতড়াস মঞ্চে উঠে আসে, আজ যদি সন্দেশখালি উঠে আসে, তাহলে তার উপস্থাপনায় সাবেকি ভাবনা থাকলে চলবে না, অভিনয় রীতির ঢঙঢাঙ-এ থাকতে হবে মৌলিক প্রয়োগ কৌশল। রাজনৈতিক কথা উঠে আসা মানেই বিরোধিতা নয়, সেটা সত্যকে উত্থাপন ও প্রতিষ্ঠা করা। এখন সেটা করতে গিয়ে, কোনোও অদৃশ্য ভয় থেকে দূরে সরে থাকল হবে না। কারণ সত্য কোন কিছুকেই মানে না। সে প্রকাশিত হতে চায়। সে সরলরেখায় যায়। আর যদি তা না পারে, তাহলে সেই সত্য কোন না কোনওভাবে বিকিয়ে গেছে। সমঝোতায় এসেছে।
অর্থাৎ আধুনিক বাংলা নাট্য চর্চায় সরকার যত টাকা পয়সা দিয়েই তুলে ধরা বা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, সেখানে মুল আঙিনায় কোনও মৌলিক ভাবনা খেলা করে না। অনুকরণের পথেই প্রথম বিশ্বের ভাবনার গরিমাকে সাথে নিয়ে, সার্কাজমের সাহায্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার একঘেয়ে কার্যকলাপ চলে। আমরা তা দেখে কতিপয় মানুষ চমকে উঠি, ঝলমলে মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রাজ্ঞ নাট্যচঞ্চুর হাত ধরে, নয়া নাট্য নীতির গোড়াপত্তনের ঢেঁকুর তুলি।
এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসাটাই আমাদের আগামীর কাজ। ভাবনাকে নতুন নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরতে হবে। তবেই বাঁচবে বঙ্গ নাট্যচর্চা। আর সেটা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই করবে, এই বিশ্বাস রেখেই শেষ করলাম।