বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ১
থিয়েটারে অভিনয় নিয়ে তেমন কোন ধারণাই ছিল না হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া থানার বনিবন পঞ্চায়েতের অধীনস্থ উত্তর পিরপুর গ্রামের মেয়ে শ্রেয়ার। তবে পারিবারিক সূত্রে এবং উৎসাহে লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ, গান, ছবি আঁকা, হাতের কাজে তার একটা আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। মায়ের বাবার অর্থাৎ মামাবাড়ির দাদুর আগ্রহ ছিল যাত্রা থিয়েটারে। সেই সূত্রে ছোট থেকেই যাত্রা-থিয়েটার দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। পাশাপাশি লেখাপড়াটাও চালিয়ে গেছে। বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষাবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। অবসর সময়ে নিজের নৃত্য প্রতিষ্ঠান চারুকলা নৃত্যাঙ্গণে নাচ ও আঁকার প্রশিক্ষণ দেয়। সব ক্ষেত্রেই প্রাণঢালা উৎসাহ জোগান বাবা হারু বেরা ও মা পম্পা বেরা।তবে সুযোগ পেলেই থিয়েটার দেখার অভ্যাসটা সে বাঁচিয়ে রেখেছিল। সেই সূত্রে এলাকার ফুলেশ্বর উদ্দীপন দলের নানা নাটক সে দেখতে যেত। এই নাট্যদলের কর্ণধার অনুপ চক্রবর্তী একজন শিক্ষাবিদ,সুপরিচিত শিক্ষক এবং অবশ্যই একজন সুপরিচিত নাট্যকার ও অভিনেতা।
অনুপবাবুর নানা নাটকের বিষয়ে গুরুত্ব পেয়েছে ইতিহাস, বিজ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তি। চন্দ্রভাগার পারে, সুলতানা রাজিয়া, অনাগত নাটকের নাট্যকার হিসাবে থিয়েটার মহলে তাঁর বিশেষ পরিচিতি আছে। তবে অনুপবাবুর দলের নাটক দেখলেও তাঁর সাথে পরিচয় ছিল না শ্রেয়ার। কিন্তু এখন সেই নাট্যদলের নির্ভরযোগ্য অভিনেত্রী হয়ে উঠেছে শ্রেয়া বেরা। তবে স্কুল জীবনে নৃত্যনাট্য,রবীন্দ্র নাটক, হাসির নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিল শ্রেয়া।
থিয়েটারে অভিনয়ের যোগাযোগের গল্পটাও বেশ অন্যরকম। তখন লকডাউন। ২০২০ সাল। ঘরে বসে দিন কাটছে। একদিন মা- বাবার কাছে আবদার করল নাচের ভিডিও বানাবে বলে। উৎসাহ দিলেন মা-বাবা। বাবা হারুবাবু মেয়েকে নিয়ে গেলেন একটি জমিদারবাড়ি সংলগ্ন শিবমন্দিরের কাছে। সেই ভিডিও যখন তৈরি হচ্ছিল তখন পেল্লাই জমিদারবাড়ির ঝুলবারান্দা থেকে তা লক্ষ্য করছিলেন এক ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী। ভদ্রলোক নেমে এসে নাম জানতে চাইলেন শ্রেয়ার। শ্রেয়ার মনে পড়ে, আরে এই মানুষটির( নাট্যকার, নির্দেশক অনুপ চক্রবর্তী) রচিত ও অভিনীত “সুলতানা রাজিয়া” নাটকে তো এনার অভিনয় সে দেখেছে। এই ঘটনার পরেও অনুপ চক্রবর্তীর “দগ্ধ সময়” নাটক দেখে শ্রেয়া। নাটক দেখতে দেখতে শ্রেয়ার মনে হত, যদি সে এইসব নাটকের একটা চরিত্র হতে পারত!
এই ইচ্ছা একদিন পূরণ হল শ্রেয়ার। অনুপবাবুর ছাত্র এলাকার জেরক্সের দোকানের মালিক দীপকবাবুর মাধ্যমে ফোন নাম্বার পেয়ে অনুপবাবু যোগাযোগ করেন শ্রেয়ার সঙ্গে। “সুলতানা রাজিয়া” নাটকে এক বাঁদীর চরিত্রে একটি কত্থক নাচের দৃশ্যে অভিনয় করার অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধ পেয়ে শ্রেয়া চলে আসে অনুপবাবুর কাছে। কিন্তু শ্রেয়ার ভাগ্যে জুটে গেল একটি চ্যালেঞ্জিং চরিত্র। “অনাগত” নাটকের প্রধান চরিত্র ওমেগা। ওমেগা একটি রোবট চরিত্র। অত্যন্ত জটিল একটি চরিত্র। এ নাটক বহু নাট্যদল অভিনয় করেছে। শুরু হল “ওমেগা” হয়ে ওঠার প্রস্তুতি। শ্রেয়া নিজেকে উজাড় করে দিয়ে “ওমেগা” হয়ে উঠতে চাইল। ওভারস্মার্ট একটি চরিত্র। যে চরিত্র এই শতাব্দীর চরিত্রগুলি থেকে অনেক এগিয়ে। যোগেশ মাইম একাদেমিতে “অনাগত” নাটকে শ্রেয়ার অভিনয় দেখে অভিভূত দর্শক উচ্ছ্বসিত করতালিতে প্রেক্ষাগৃহ ভরিয়ে দিল। এই দলের “চন্দ্রভাগার পারে” এবং “দগ্ধ সময়” নাটকেও শ্রেয়া বেরার অভিনয় নাটকের সাফল্যের সোপান হয়ে উঠল। শ্রেয়া অবশ্য সবটুকু কৃতিত্ব দিতে চায় নির্দেশক স্যার অনুপ চক্রবর্তীকে। কথায় কথায় শ্রেয়া জানালো, স্যার তৈরি করে নিয়েছেন৷ অভিনীত সব চরিত্রগুলোই কঠিন।কিন্তু প্রশিক্ষণের গুণে সহজ হয়ে গেছে। নির্দেশক অনুপবাবু জানালেন, শ্রেয়া একটা আবিষ্কার। জটিল চরিত্রকে ও প্রতিভার গুণে সহজ করে নিতে পারে। এরা যদি থিয়েটারে থাকে, তবে থিয়েটার সমৃদ্ধ হবে।
কলকাতার তপন থিয়েটার, ভোলাগিরি মঞ্চ, যোগেশ মাইম একাদেমি, রবীন্দ্র ভবন, টাকির মঞ্চে অভিনয় করে উৎসাহিত অভিনেত্রী শ্রেয়া জানিয়েছে, অবসাদে ভুগছিলাম একসময়। থিয়েটার আমাকে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছে। নিজেকে আবিষ্কারের সুযোগ দিয়েছে। তাই সবকিছু করেও থিয়েটারে থেকে যেতে চাই।
(চলবে)