ঋদ্ধিমা দে
“যখন জন্মসূত্রে সত্যই শাহজাদা ছিলাম তখনও নিজেকে ফকির মনে করতাম…” আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারাধীন দারার এই উক্তি দর্শকের মর্মে আঘাত করে। ভারতে ইসলামের প্রসার ঘটে সুফি সন্তদের হাত ধরে। গজল, কাফি ও ক্বিসসা এ দেশের প্রতিটি দরজায় কড়া নেড়ে পৌঁছে দেয় আলহার উদারতার ইস্তেহার। মধ্যযুগে হাজারো হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে সুফিবাদ, দারা শিকোহও পেয়েছিলো সেই অমৃতের খোঁজ। ৩০০ বছরের মোঘল সাম্রাজ্যের অন্দরের ও অন্তরের কথা বলে “তাজমহল”। সুফি সুতোয় বোনা গল্পের পরতে পরতে উদারতার চিহ্ন।
হর ভট্টাচার্যের একটি অসামান্য স্ক্রিপ্ট থেকে নির্মিত, সুদীপ্ত দত্ত নির্দেশিত ‘গয়েশপুর সংলাপ’-এর নাটক “তাজমহল”। এ নাটক অন্যভাবে ভাবায়। এ নাটক দারাকে দাঁড় কড়ায় কাঠগড়ায় আবার ফুটিয়ে তোলে আউরঙ্গজেবের শিশুসুলভ মানবিক দিক, তুলে ধরে সফেদ গোখরোর হিংস্রতার নেপথ্যে অবহেলার ইতিহাস।
ইতিহাসের সমস্ত চরিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে স্টেজে। সাহজাহান, আউরঙ্গজেব, দারা শিকোহ, জাহানারা বেগম, জেব্রুন্নিসা সকলে মেলে ধরে তাদের হৃদয়পুরের মানচিত্র। দারার লফজে উপনিষদ ও পবিত্র আল কোরান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।বিদ্বেষের রাজনীতিকে পরাজিত করে, এই সংলাপ দর্শকের হৃদয়ে বিছিয়ে দেয় ইশকে বোনা শীতলপাটি।
এ নাটক বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এক দূরন্ত ভাষ্য। দারা শিকোহ, আউরঙ্গজেব ও তাদের আপা জাহানারা শৈল্পিক মুনশিয়ানায় সাবলীলভাবে বলে চলে রাজনীতি, ধর্ম, প্রেম ও বিদ্বেষের জটিল তত্ত্ব কথা। ব্যবহৃত সুফি নাচ ও গান উপস্থাপনাটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে!
দারার মৃত্যুর দৃশ্যে একটি বৃহৎ লাল কাপড়ে ঢেকে দেয় প্রার্থনারত আউরঙ্গজেবকে। রক্তস্নাত হয় ধর্মান্ধতা। এ নাটক বারংবার ধর্মীয় গোঁড়ামির মূলে আঘাত হানে। ভরা সভায় দারা, একজন সচ্চা মুসলমান, একইসাথে স্মরণ করে আল কোরান ও উপনিষদ। দারা ব্রহ্মের অন্বেষক।
নাটকের মাঝে মাঝেই আমরা ফিরে আসি বর্তমান দিল্লিতে, যে দিল্লি পুড়ছে দাঙ্গার আগুনে। এ যুগেও কারোর হয়তো মনে হয়েছে তাদের ধর্ম “খতরে মে!” কালে কালে তৈরি হয় একদল মৌলবী, যারা তথাকথিত ঈশ্বরের দূত। এই স্বঘোষিত দূতেরা লাগামহীন স্বেচ্ছাচারে ঘুরিয়ে দিতে চায় ধর্মের, বিশ্বাসের গতিপথ। হঠাৎই এত বছরের রাজ্যশাসনের পরে তাদের মনে হয় “ইসলাম খতরে মে!” ব্যাক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার লোভে হাকিম দাউতের মতো একজন নিজেকে বিকিয়ে দেয় ইস্পাহানের সম্পত্তি বিস্তারে। আবার আপাত ভাবে বহিরাগত হলেও নিকোলাইয়ের মতো প্রকৃত বন্ধুও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় দারার দিকে।
কোর্টের দৃশ্য দর্শকের মনে জন্ম দেয় হাজারও প্রশ্ন, যে প্রশ্ন নিজেকে নিজের সামনে এনে দাঁড় করায়। জাহানারা বেগমের মমতাময়ী রূপ এবং তার বুদ্ধিদীপ্ততা ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে একজন আদর্শ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের নজির গড়ে তোলে। এ গল্পে আমরা খুঁজে পেয়েছি জেবউন্নিসাকে।আউরঙ্গজেবের কন্যা, কবি জেবউন্নিসা। সুফি চেতনায় পরিপূর্ণ এক অসামান্য নারী সে। “জেবউন্নিসা তোমার কবিতা আমার মর্মে আঘাত করে!” সত্যিই তার কলম ও কালাম আমাদের মর্মে আঘাত করেছে। নাটকের শেষে হিংসা ভুলে প্রেমের পাঠ দেয় জাহানারা। আমরা মঞ্চে দৃশ্যত দেখতে পাই উজ্জ্বল তাজমহল। তার সামনে ভাটিয়ালি সুরে ভেসে যাচ্ছে সুফি পীর।
স্বাভাবিক সরল মঞ্চ সজ্জা এবং মনোজ প্রসাদের আলো প্রক্ষেপণ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। দারা শিকোহর চরিত্রে সুদীপ্ত দত্ত দর্শকের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয়। সমরেশ সাহা তার শৈল্পিক মুনশিয়ানায় বাস্তবেই যেন আওরঙ্গজেব হয়ে ওঠেন। সুরজিৎ নন্দীর গলায় জাদু আছে। মোহগ্রস্ত করে রেখেছে তার কন্ঠ গোটা নাটক জুড়ে। পারমিতা সিংহ রায় এবং পঙ্কজ সিংহ রায়ের কোরিয়োগ্রাফি দেখে বারবার গায়ে কাঁটা দিয়েছে মুগ্ধতায়। সমস্ত কলাকুশলীদের অভিনয় যথেষ্ট নিষ্ঠার প্রমাণ রেখে যায়। ঠিক শেষ দৃশ্যে ভেসে যাওয়া নৌকার মতোই এ নাটক পাড়ি দিক দূরে, সুদীর্ঘ হোক তাজমহলের চলার পথ। জয় হোক।