বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম: পর্ব ৬
দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিদ্যানগরের কৌশিক চ্যাটার্জী এখন থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে।মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছে এই মাধ্যমকে। থিয়েটারে নানা চরিত্র হয়ে ওঠা অথবা কখনো সে যা নয় বা যেমন নয় – তাই হয়ে ওঠা বা তেমনি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে থিয়েটার তার কাছে একটা প্রিয় মাধ্যম। অথচ কোন বিশেষ ইচ্ছে বা বাসনা নিয়ে থিয়েটার করতে আসেনি কৌশিক। বাড়িতে বাবা, জেঠু সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত। কৌশিকেরও ছোট থেকেই সিনেমা, টিভি দেখার অভ্যাস ছিল। এভাবে অজান্তেই কখন অভিনয় নামক শিল্পটির প্রতি তার একটা গোপন ভালবাসা জম্মে যায়। তাই এক বন্ধুর মাধ্যমে থিয়েটারে যুক্ত হয় বিদ্যানগরের কৌশিক চ্যাটার্জী।তারপর যেন থিয়েটারই তাকে আঁকড়ে ধরেছে। তারপর কতবার কত নাটকে কত চরিত্র হয়েই না সে মঞ্চে নেমেছে। সেই সব চরিত্রের আনন্দ – বেদনাকে সে মূর্ত করে চলেছে নানা নাটকে।
তার জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে বিদ্যানগর রোদ্দুর নাট্যসংস্থা। এই নাটকের দলেই সে প্রথম থিয়েটার করতে এসেছিল। এই দলের সঙ্গে তার প্রাণের যোগ। তাই কৌশিক প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারে, এই দলের সঙ্গেই থেকে যাব। অথচ এলাকায় কৌশিকের পরিচিতি ছিল একজন দক্ষ ক্রিকেটার বা দৌড়বাজ হিসাবে। এখন সেই কৌশিক বুক ফুলিয়ে বলে : আমি থিয়েটার করি।
তার এই থিয়েটারে আসা নিয়ে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে আছে তার প্রাক মাধ্যমিক জীবনের দুটো ঘটনা। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই বাবার মৃত্যু এবং পা ভেঙে যাওয়া তাকে ভীষণভাবে একা করে তুলেছিল। সেই একাকীত্ব যখন অবসাদ হয়ে তাকে প্রতিদিন হাঙরের মত একটু একটু করে গ্রাস করছিল তাকে, তখন বিনয় নামে এক বন্ধু যেন বসন্তের দূতের মত এসে বলেছিল : চল, থিয়েটার করবি।… কৌশিকও যেন একটা কিছুকে আঁকড়ে ধরে একটু অন্যভাবে বাঁচতে চাইছিল। তাই বন্ধুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যুক্ত হয় বিদ্যানগর রোদ্দুর নাট্যসংস্থার সঙ্গে। সেই অবসাদের জীবনে থিয়েটার যেন সত্যিই তার জীবনে মুঠো মুঠো রোদ্দুরের আশ্বাস নিয়ে এসেছিল। এই রোদ্দুর নাট্যসংস্থার প্রাণপুরুষ বাংলা থিয়েটারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শুভাশিস খামারু। সেই শুভাশিস খামারুর কাছ থেকে থিয়েটারের পাঠ নিতে নিতে কখন যেন কৌশিকই রোদ্দুর হয়ে উঠেছিল।
এই বিদ্যানগর রোদ্দুর নাট্যসংস্থার প্রযোজনা ” বুঝবে খুঁড়ো বেলা হলে ” নাটকে তার প্রথম অভিনয়। এ নাটকের নাট্যকার এবং নির্দেশক শুভাশিস খামারু। তাঁর কাছে জীবনের প্রথম নাটকে থিয়েটারের পাঠ নিতে নিতে কৌশিক অনুভব করেছিল, থিয়েটার আসলে নিজেকে আবিষ্কারের একটা শক্তপোক্ত মাধ্যম। তাই থিয়েটারকে সে যেমন আঁকড়ে ধরেছিল থিয়েটারও তাকে তেমনি আঁকড়ে ধরেছিল।
এরপর বহু নাট্যদলে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে কৌশিক।নানা চরিত্রে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের ইচ্ছায় সেইসব নাট্যদলেও নানা নাটকে সে অভিনয় করেছে। ঠাকুরপুকুর রাজাসাজা, বরিষা দামাল,ইচ্ছে নাট্যসংস্থা, অজিতেশ নাট্য একাদেমি , শ্যামবাজার মুখোমুখি৷ উত্তরপাড়া সমতট, উত্তরপাড়া দৃশ্যায়ণ, সিঁথি স্বপ্নচারী, বারাসাত রমেশপল্লী থিয়েটার গ্রুপ হাতিবাগান সংঘারাম, যাদবপুর নাট্য ঐক্য, নেতাজীনগর নাট্য সংস্থা, মরমিয়া, পিউপা, নয়াবাদ তিতাস, হাতিবাগান শিল্পীচক্র, জাহ্ণবী সাংস্কৃতিক চক্র, বীরভূমের আনন , নাট্যশালা কলকাতা, রাহুল বোস ক্রিয়েটিভ এন্ড পার্ফমিং আর্টস সহ মিনার্ভা রেপার্টারি থিয়েটার ( ২০১৮-২০২১) – এতগুলি নাট্যসংস্থার সঙ্গে তার যোগসূত্র ঘটেছে থিয়েটারের মাধ্যমেই। এমন কি মিনার্ভা রেপার্টারিতেও সে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। একসময় অবসাদে বিপন্ন হয়ে যাওয়া বিদ্যানগরের সেই ছেলেটিকে থিয়েটারই আলোর পথ দেখিয়েছে।
স্বভাবতই এতগুলি নাট্যদলের সাথে যোগাযোগের সূত্রে তার অভিনীত নাটকের সংখ্যা অনেক। রোদ্দুর দলেই প্রায় ১৫ টি নাটকে অভিনয় করেছে। শ্যামবাজার মুখোমুখিতে লম্বকর্ণ পালা, অজিতেশ নাট্য আকাদেমিতে তিন পয়সার পালা, সমতটে মার্চেন্ট অফ ভেনিস। দমদম স্বপ্নচারীতে নটবর, ডিব্লু ডিলু টিবলু টিলু – ডুব।মিনার্ভা থিয়েটারে নাসিকা পুরাণ, পাঁচকড়ির গপ্পো,মুম্বাই নাইটস এ অভিনয় তার জীবনের পরম পাওয়া।এছাড়া বিভিন্ন দলে বহু মঞ্চসফল নাটকে সে অভিনয় করে থিয়েটারে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। হাতিবাগান সংঘারামে বিনয়ের জীবন তার আর একটি অভিনীত নাটক। সব মিলিয়ে ৪০ টির বেশি নাটকে অভিনয় করেছে সে।এখনও করে যাচ্ছে।এক একটা চরিত্র তার কাছে এক একটা চ্যালেঞ্জ।
থিয়েটার তাকে বাঁচার মত বাঁচতে শিখিয়েছে – এ কথাটা সে আজ মাথা উঁচু করে বলতে পারে। থিয়েটারে আসার আগে এবং পরে তাকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছে তার মা। যেহেতু কিশোরকালেই বাবার মৃত্যু তাই মা এর ঋণ তার থিয়েটার জীবনে অপরিশোধ্য। অভিনীত সব চরিত্রই তার কাছে প্রিয় বলে সে জানিয়েছে। মালীর কাছে যেমন বাগানের সব ফুলই প্রিয় – তার কাছে তেমনি অভিনীত সব চরিত্রই প্রিয়। থিয়েটারের দল তার কাছে একটা পরিবারের মত। বিভিন্ন নাট্যদলে অভিনয় করে সে – তাই এক একটা নাট্যদল তার কাছে এক একটা আত্মীয়বাড়ির মত। এই বিশ্বাসে নিহিত থেকেই আরো বহুকাল থিয়েটারে থাকতে চায় কৌশিক।