দেবা রায়
মনোজ মিত্র, বাংলা নাট্য ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। নাটকের বয়ানে তিনি নিয়ে এসেছেন বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরার নানান গল্প ও সংলাপ, যা কৌতুক রসে আশ্রিত। তাঁর নাট্য লেখনীতে জীবনবোধের চরম সত্যগুলিকে উদ্ঘাটন করেছেন সেই কৌতুক রসাস্রিত নৈর্ব্যক্তিকতা দিয়েই। বাস্তব আর পরাবাস্তবের মাঝে অনাবিল হাস্য রসের সরল সংলাপগুলি যেন আমাদেরই ঘরের কথা। আমাদের অতি পরিচিত। বাংলা নাট্য চর্চায় আজও যখন শুরু হয় ‘কোন নাটক ধরা হবে?’ উত্তরে সব নামের সাথে একটা নাম অবশ্যই থাকে, সেটা ‘মনোজ মিত্র’ অর্থাৎ ‘মনোজ মিত্রের নাটক’। যা বাংলা নাট্যচর্চার সংস্কৃতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
মনোজ মিত্রের লেখনীর গুণগ্রাহী অভাব এই বাংলায় কেন ওপার বাংলাতেও নেই। বর্ষীয়ান নাট্যকার অশোক মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখনী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন- ‘নাটক রচয়িতা মনোজ মিত্রের বহু গুণের মধ্যে প্রথম যেটি আমার নিঃশ্বাস কেড়ে নেয়, তা হচ্ছে বৈচিত্র। মনোজের নাট্যভূবন যেন নানা রঙে-রেখা- ভঙ্গি-সুরে ভরপুর মনোগ্রাহী, বিশাল এক মেলার মতো। যার যেমন চাই সে তেমন খুঁজে নিতে পারে, তাঁর সৃষ্টির বিপুল সম্ভার থেকে। হয়তো এই কারণেই এই নাট্যকারের জনপ্রিয়তা এতো গভীরে।‘
আসলে মনোজ মিত্র তাঁর চারপাশের জগতটাকে অনেক বড় করে দেখেছেন এবং সেটা দেখিয়েছেন তাঁর নাট্য রচনায়। তাঁর নাটকে রাজনৈতিক কথা এসেছে সামাজিক সমস্যা উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। গোদা বাংলা সরাসরি রাজনৈতিক কথা বলে লেখনীর নান্দনিকতাকে কখনোই নষ্ট হতে দেন নি। তাঁর নাট্যশৈলীর আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট সরাসরি সামাজিক শ্রেণীর কথা না বলে ব্যক্তি বা পরিবারের সমস্যাকে প্রধান্য দিয়েছেন।
তাঁর রচনায় ‘চাক ভাঙ্গা মধু”(১৯৬৯) ও ‘সাজানো বাগান’(১৯৭৭) নাটকে আছে শ্রেণীসংগ্রামের লড়াই। আছে শাসকের প্রতি শোষিতের বিদ্রোহ ঘোষণা। শোষিত সমাজের প্রতিনিধি হয়ে আজও ‘মাতলা’, ‘জটা’, ‘বাদামী’ ও ‘বাঞ্ছা’র মতো চরিত্ররা বাঙালি অন্তরে জায়গা করে রেখেছে। আবার শাসকের ভয়ঙ্কর রূপ দেখাতে ‘অঘোর’, ‘ছকড়ি-নকড়ি’ অনবদ্য সৃষ্টি-কে মনে রাখতেই হবে। আবার ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’তে(১৯৮৮) পাচ্ছি মমতাময়ী মায়ের অপূর্ব চিত্রণ।
তাঁর এই ধরণের সমাজ সচেতনতামূকক নাটকের মধ্যে আরও যে নাটকের নাম করা যায়, সেগুলি হল- ‘নেকড়ে’(১৯৬৮), ‘কেনারাম বেচারাম’(১৯৭০), ‘পরবাস’(১৯৭০), ‘শোভাযাত্রা’(১৯৯০), ‘দর্পণে শরৎশশী’(১৯৯১), ‘আত্মগোপন’(১৯৯৪)।
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে অসামান্য ভাবে ব্যক্ত করেছেন বাংলার আর এক নাট্যজ্ঞ কুমার রায় মহাশয়- ‘স্বাধীনতার পর যে নতুন ভাবনা, যে নতুন দায়িত্ববোধ, যে নতুন উত্তেজনা- তখন তার অবসান ঘটেছে। রাজনৈতিক আকাশ সমাকীর্ণ নানা সুবিধাবাদের জঞ্জালে। মানুষের বাঁচার সমস্যা নতুন মাত্রা পেয়েছে। অনুভূতিশীল আধুনিক মানুষের অসহায় এবং নিঃসঙ্গ আর্তি ফুটে উঠেছে তখন, ধনবাদী সভ্যতার ব্যাধি নিয়ে। সে এক ক্ষুব্ধ অস্থির উৎকেন্দ্রিক সময়। যে আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা মানুষের মুক্তি দিতে পারে… সেই বিশ্বাসের আধারে বেনোজল ঢুকে পড়েছে… বিশ্বাস টুকরো হয়ে গেছে। প্রথম যুক্তফ্রন্ট, নকশাল বাড়ি আন্দোলন দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। … এরই মধ্যে সত্তর দশকের টালমাটাল অবস্থা, জরুরী অবস্থা, মৃত্যু, বিভীষিকা, বামফ্রন্টের বিজয়, প্রতিষ্ঠাকাল, শাসন ও রাজত্বকাল। এই সময়ে মনোজ মিত্র নাটক লিখছেন।‘
‘মেষ ও রাক্ষস’(১৯৭৯) নাটকটির মধ্য দিয়ে মানুষের শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা দেখিয়েছেন নাট্যকার। নাটকে দেখতে পাই হীরামনের মেষের চামড়া আগুনে পুড়ে শুদ্ধ হয়, এবং সুবর্ণ ও নীলকমলের সহায়তায় রাক্ষস নিধন করে। অর্থাৎ নাট্যকার মনে করতে শেখালেন, যতক্ষণ না আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়, ততদিন রাক্ষসরূপ শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়।
‘রাজদর্শন’(১৯৮১) নাটকে দেখতে পাই শাসক শ্রেণীর পরিবর্তন ঘটলেও শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হয় না। কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন স্বজনপোষন, রাজত্ব রক্ষা, বিবেকবোধ শূন্যতা, স্বার্থরক্ষা কীভাবে মানুষকে প্রতারণার মাধ্যম হয়।
আধুনিকতা মানুষকে কালিমালিপ্ত করে, ভুল পথে চালিত করে। তার এই আধুনিকতার ওপর বিন্দুমাত্র আস্থা ছিলো না বলে তাঁর কলমে উঠে আসে, ‘কিনু কাহারের থ্যাটার’(১৯৮৮) আর ‘পুঁটি রামায়ন’(১৯৮৯-৯০) নাটক দুটিতে।
নাট্যকার বেঁচে থাকেন তার সৃষ্টিতে। মনোজ মিত্রের এই চলে যাওয়া আসলে চলে যাওয়া নয়। এ তাঁর জাগতিক অনুপস্থিতি। কিন্তু তার নাটক আমাদের অন্তরে, আপামর বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন উপস্থিত থাকবে। তাঁর শিল্প স্বত্বার বহুমুখী প্রতিভায় আমরা বিস্মৃত হব না। নাট্যমঞ্চে তার অভিনয় দক্ষতা মাইলস্টোন বাংলা নাটকের জন্ম দিয়েছে। এমনকি চলচ্চিত্রেও তার অভিনয় তাকে অমর করে রাখবে। নাটক অভিভাকত্বে তৈরি নাট্যদল ‘সুন্দরম’ থেকে তিনি একেরপর পর এক সফল প্রযোজনা বাংলার নাট্যমোদি দর্শককে উপহার দিয়ে গেছেন। এই আলোচনায় আমরা তার লেখনীর দিককে আলোকপাত করে উপস্থাপন করলাম।
তাঁর কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিরূপে প্রাপ্য পুরস্কারগুলি হল- শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৫), সেরা নাট্যকারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার (১৯৮৬), শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পুরস্কার (১৯৮৩ এবং ১৯৮৯), এশিয়াটিক সোসাইটির স্বর্ণপদক (২০০৫), শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পূর্ব (১৯৮০), বাংলাদেশ থিয়েটার সোসাইটি থেকে মুনীর চৌধুরী পুরস্কার (২০১১), দীনবন্ধু পুরস্কার (২০১২), কলাকার পুরস্কার।
১৯৮৫ সালে কৃষ্টি পত্রিকায় নাট্যকারের কথা দিয়েই এই লেখার ইতি টানছি। তিনি সেখানে লিখছেন- ‘আমি এই মুহুর্তে একটি বিষয়কেই অধিকার দিয়ে লিখতে চাই, সেটা হল, দীন মানুষ, দুর্বল মানুষ, অবহেলিত এবং পর্যুদস্ত মানুষ, তার হীনতা, তার দুর্বলতা, তার ভয়, দ্বিধা, সংশয় কাটিয়ে মানুষের মতো উঠে দাঁড়াচ্ছে। এদেশের যে কোনো ঘটনার মধ্যেই আমি েই মানুষকে খুঁজি, মানুষের এই সংগ্রামকেই ধরতে চাই।‘