বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ১৬
কলকাতার দত্তপুকুরের সন্দীপ ঘোষ এখন থিয়েটারের উজ্জ্বল মুখ। বলা যেতেই পারে, থিয়েটারে তার মন মজেছে। তাই দাপিয়ে থিয়েটার করে চলেছে সন্দীপ। থিয়েটারের ক্ষেত্রে যে একগুচ্ছ তাজা মুখ প্রতিদিন থিয়েটারকে জীবিকা করে বাঁচতে চাইছে, সন্দীপ তাদের একজন।
ছোটবেলা থেকেই সে নাটকের সাথে যুক্ত। যখন কেজি ওয়ানের ছাত্র, তখনই ‘ABC ZOO’ নামে একটা নাটকে সাপের চরিত্রে অভিনয় করেছিল। সাপের চরিত্র মানেই বুকে ভর দিয়ে চলতে হয়েছিল তাকে। সেই বয়সে এই ধকল নিতে গিয়ে জ্বর এসে গেছিল সন্দীপের। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেয়নি থিয়েটার থেকে। হয়তো প্রথম থিয়েটারেই শিখে গিয়েছিল যে, থিয়েটার করতে গেলে বা কোন চরিত্র ঠিক মত ফুটিয়ে তুলতে হলে কষ্ট করতে হয়। তাই তার পরবর্তীকালেও পাড়ার নাটক, স্কুলের নাটক এবং তার জন্মস্থান দত্তপুকুরের দলে নাটক করেছে। পরবর্তীতে পড়াশুনোকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনে বছর ছ’য়েক নাটক করেনি কোথাও। গ্রাজুয়েশন পাঠ নেওয়ার পরে আবার জোরকদমে শুরু করেছিল। তারপর থেকে এখন (২০২৪) পর্যন্ত একটানা সাত বছর জড়িয়ে আছে থিয়েটারে। এখন সে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়তে চায় থিয়েটারে।
ছোট থেকেই তার একটা দক্ষতা ছিল। সেটা হল, দূরদর্শনের পর্দায় কোন নাচ – গান দেখে ভাল লাগলেই সেটা সে অবিকল তুলে নিতে পারত। বাড়িতে মাসি,পিসি,আত্মীয়রা এলেই তার নাচগান দেখতে চাইত। এ সময় সন্দীপের বাবার এক বন্ধু তার বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ছেলেটাকে এবার মঞ্চে তোলো। তখন থেকেই বিভিন্ন মঞ্চে নাটক, গান, কবিতা পাঠের জন্য সন্দীপের মঞ্চে ওঠা। তবে তারপরে তার মনে হয়, বৃহৎ পরিসরে নিজেকে আবিষ্কার করতে হলে থিয়েটারই সেক্ষেত্রে উপযুক্ত মাধ্যম। কারণ, থিয়েটার এমন একটা শিল্প যার সাথে আরো কিছু শিল্পের (নাচ,গান ইত্যাদি) যোগ আছে এবং সেই মাধ্যমে নিজের পারদর্শীতা প্রমাণের উপায় আছে।
সেই থেকে সন্দীপ থিয়েটারে জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে তাকে সাহস যুগিয়েছিলেন তার স্যার প্রণব চক্রবর্তী। প্রণববাবু সন্দীপের মত কয়েকজন ছাত্রকে একত্রিত করে নিজেই একটা নাটকের দল তৈরি করেছিলেন।সন্দীপ তখন নবম শ্রেণি। সে দল বেশিদিন না টিকলেও প্রণব স্যারের “এসো নাটক শিখি” নাট্যদলের স্মৃতি তার জীবনে প্রেরণার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেখানে প্রণব চক্রবর্তীর পরিচালনায় “সূর্যের দেশে যাওয়া” কেই সন্দীপ তার সচেতন থিয়েটার যাপন বলে মনে করে।
এরপর বিভিন্ন নাট্যদলেই অভিনয় করেছে সন্দীপ। নানা নাটকে নানা চরিত্রে। সেই দলগুলি হল : বেহালা এন্থেম, নিউ ব্যারাকপুর দৃশ্যান্তন, চন্ডীতলা প্রম্পটার ইত্যাদি। এখন দমদম শব্দমুগ্ধ নাট্যদলের একনিষ্ঠ অভিনেতা সন্দীপ। ২০২০ সাল থেকে জড়িয়ে আছে শব্দমুগ্ধে মুগ্ধতার সঙ্গে। সে জানিয়েছে, এই শব্দমুগ্ধে সে আজীবন থেকে যেতে চায়।
শব্দমুগ্ধ নাট্যকেন্দ্রে নিজেকে আবিষ্কার করার সুযোগ পেয়েছে সন্দীপ। এই দলের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা “স্যাফো চিত্রাঙ্গদা” নাটকে বসন্ত চরিত্রে অভিনয় করে সে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পেয়েছে। পরিচালক রাকেশ ঘোষ যখন নাটকটা পড়ছিলেন সেই স্ক্রিপ্ট শুনতে শুনতেই সে বসন্ত চরিত্রটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল।নির্দেশক রাকেশ ঘোষ ঐ চরিত্রের জন্য সন্দীপকেই নির্বাচন করেছিলেন। সিস্টেমের কাছে বারবার ব্যবহৃত হতে হতে সিস্টেমের কাছেই শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়াতে বাধ্য হওয়া এই চরিত্রটি সন্দীপকে যোগ্য অভিনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ দিয়েছে বলে সন্দীপ জানিয়েছে।
থিয়েটারের জগতে থাকতে থাকতে মানুষ চেনার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। পেশাদারিত্ব বজায় রাখার জন্য সে একজন প্রকৃত সৎ মানুষ হওয়ার পাঠ নিয়েছে।পরিচালক রাকেশ ঘোষের পাশাপাশি আর এক কুশলী শিল্পী রঞ্জন বোসের কাছেও সে কৃতজ্ঞ থাকতে চায় আজীবন।সে মনে করে, এই দুজন তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে।
সন্দীপের এই থিয়েটার যাপনে তার মা বাবা প্রতিনিয়ত তাকে সাহস যুগিয়েছে।থিয়েটারের পাশাপাশি জার্ণালিজম এন্ড মাস কমিউনিকেশনে স্নাতকোত্তর হয়েছে সন্দীপ।তার থিয়েটার যাপনে তার মা বাবা সবসময় পাশে থেকেছেন। নিজেকে তাই ভাগ্যবান মনে করে সন্দীপ।
সন্দীপ অভিনীত নাটকগুলি হল: লালকমল, নীলকমল, রক্তকরবী, আলাদিন এক আশ্চর্য প্রদীপ,সূর্যের দেশে যাওয়া, ক্ষুদিরাম, জিহাদ, ভোমর, নিয়ম ভাঙার খেলা, ইরাবান গাথা, দেবতার দাসী, হাতবদল,নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ,স্তন্যপায়ী, মায়ামৃদঙ্গ, স্যাফো চিত্রাঙ্গদা ইত্যাদি নাটকে উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করেছে সন্দীপ।
ইংরেজি সাম্মানিক হিসাবে স্নাতক এবং এবং জার্ণালিজম এন্ড মাস কমিউনিকেশনের স্নাতকোত্তর সন্দীপ থিয়েটারকেই বেছে নিয়েছে তার বেঁচে থাকার ক্ষেত্র হিসাবে। নিউ ব্যারাকপুর দৃশ্যান্তনের হাত ধরে তার তার সচেতনভাবে নাটকের জীবন শুরু।
সন্দীপ ২০১৯ এ দৃশ্যান্তন আয়োজিত উদ্যমে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছে।পরপর দু বছর পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত প্রেসিডেন্সি বিভাগে নাট্যকর্মশালায় যোগ দিয়েছে। থিয়েটারে রঞ্জন বোস, রাকেশ ঘোষ, কল্পনা বড়ুয়া, প্রদীপ রায়, শ্যামাশিস পাহাড়ী, প্রমুখের সঙ্গে অভিনয় করেছে সন্দীপ।শব্দমুগ্ধের ঋতুপর্ণ ঘোষ নাটকে ব্যাকস্টেজে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে তার। শৌভিক ঘোষের পরিচালনায় ভোমর এবং জিহাদ নাটকে অভিনয় করেই থিয়েটারের মূল স্রোতে ফেরা তার।
সন্দীপ মনে করে, থিয়েটার করে থিয়েটার করে বাঁচাটা পুরোপুরি নিজের ওপর নির্ভর করে। সে মনে করে, মনেপ্রাণে পেশাদার থিয়েটার শিল্পী হলে নিশ্চয় বাঁচা যায় থিয়েটার করে। প্রসেনজিৎ বর্ধন, রঞ্জন বোসের মত শিল্পী সেক্ষেত্রে তার কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাই থিয়েটারে জড়িয়ে থেকেই জীবনে বাঁচার রসদ সংগ্রহ করেই বাঁচতে চায় সন্দীপ।তার মনে হয়, প্রকৃত থিয়েটার শিল্পী থিয়েটার ছাড়া বাঁচতে পারে না।