সাক্ষাৎকার – দেবাশিস রায়
প্রশ্ন – আপনার শৈশব থেকে এই নাট্যজগতে আসার প্রেক্ষাপটটা যদি আমাদের
বলেন।
ডঃ শুভ জোয়ারদার – বেশ, অন্য আর পাঁচজনের মতো আমার ছোটবেলাটাও কেটেছে খুবই শান্তিপুর্ণভাবে।
কলকাতা থেকে মফঃস্বল, একটা শহরে খরদহ বলে একটা জায়গায়, গঙ্গার তীরে
একটি জায়গায়, দূর্গোতসব, শ্যামের রাস উৎসব, এই যে সম্মেলনগুলো বা ধর্মীয়
আচার অনুষ্ঠানগুলো হত, এর ভেতরে অনেক নাটক অনেক উৎসব হত, মানে
আমার বেরে ওঠাটা হচ্ছে আসলে চারের দশকে, মানে আমার জন্ম ১৯৪৪ সালে
জন্ম তো। মানে আমি একজন পরাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক। কালটা ভাবুন, সেই
সময় গণনাট্যের যুগ, আবার আমার বাড়িতে এসে হয়তো গণনাট্যের কোন মানুষ
দিদিদের গান তোলাচ্ছেন, হয়তো বিধায়ক ভট্টাচার্যের ক্ষুধা হচ্ছে বা কোথাও
গণনাট্য সংঘের আলোচনা টালোচনা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তখন কমিউনিস্ট পার্টি
প্রায় নিষিদ্ধ বলা যায়, বা হবে হবে করছে, মানে একটা তথাকথিত বামপন্থী
পরিবেশ আমি ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারছি, সেই পরিবেশের মধ্যে আমি মানুষ
হয়েছি। নাটক দেখেছি, ঠাকুমার কোলে বসে যাত্রা দেখেছি, সেই বিবেক পরাক্রান্ত
রাজা আছে, হা-হা করে অট্যহাসি হাসছে, নরমুণ্ড নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তার
নাকের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে বিবেক গান গাইছে, এই বিষয়গুলো আমাকে খুব
নাড়া দিত। একটা নাট্যবোধ আর বামপন্থী বাতাবরণে থেকে কোথাও কিছু একটা
সেডিমেন্টেশন পড়ে তো, তা সেই বয়সে সেটা ছিল, তারপরে বালক বয়সে এসে
মা মাসিমার শাড়ি দিয়ে, তাদের বিশাল বড় ছাদ সেখানে তথাকথিত নাট্যচর্চা,
মজা করেই বলছি, বাল্যখিল্যের নাট্যচর্চা সেইসবও হয়েছে বা ক্লাস এইটে পড়ার
সময় নিজেই ডিরেকশান দিয়ে পাড়ার তক্তপোষ নিয়ে বন্ধুনবান্ধবকে নিয়ে, সুনির্মল
বসুর বীর শিকারি বা সুকুমার রায়ের ঝালাপালা এইসব নাটকের ডিরেকশন
হয়েছে, কিছু কিছু নাটকে সুরও দিয়েছি মনে পরে। ঝালাপালা নাটকের একটা সুর
দিয়েছিলাম, তখন জানতাম না সুকুমার রায় কে! এই সব কিছুর মধ্যেই বোঝা
যাচ্ছে যে বাতাবরণটা কি ছিল! এইসব করতে করতে আর পাঁচটা খুবই সাধারণ
ছেলেমেয়ের মত বড় হয়ে আমি ৬১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করলাম। তখনকার
দিনে স্কুল ফাইনাল পাস করে আমি কলকাতায় চলে আসি কলেজে পড়তে। গোয়েঙ্কা
কলেজ অব কমার্স এন্ড বিসনেস এডমিনিস্ট্রেশন, ওখানে ভর্তি হলাম এবং বাবাও
কলকাতায় চলে এলেন, আমার পড়াশুনো এবং ওনার চাকরি বাকরি ইত্যাদি
সুবিধার জন্যে। ক্যালকাটা ইলেকট্রিক ল্যাম্পের একজন বড়বাবু ছিলেন। এই যে
ছেলেবেলা, এর ভেতরে আর কোন নাট্যচর্চার আর কোন সুযোগ ছিল না, সময়টা
হচ্ছে- ষাটের দশক। নাট্যচর্চা করার সুযোগ ছিল না বা আমি আর পাঁচটা
সাধারণ ছেলের মতোই দিন কাটাতাম।
কলেজে পড়ার সময় একবার দুবার হয়তো
নাটক লেখবার চেষ্টা করেছি, আমার সাহিত্য চর্চাটা কিন্তু বরাবরই ছিল। ক্লাস
এইট থেকে। একবার বাবা আমাকে, অঙ্ক দিয়ে বাজারে গেছেন, আমি তখন
সেভেন-এইটে পড়ি, আমি ‘পাত্র চাই’ নাটক লিখছি। তখন শুনেছি ‘ভারাটে চাই’
নাটকটা বেরিয়েছে, বিখ্যাত নাটক, সেটা শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি লিখছি ‘পাত্র
চাই’। বাবা বাজার থেকে এসে, আমার কান টেনে ছিঁড়ে দিচ্ছেন। এইসব
রেফারেন্স থেকে বোঝা যায় যে, কাজটা আমি করতাম, যেভাবেই হোক। এরপরে
চাকরিবাকরি, তার আগে গ্র্যজুয়েশন করি ১৯৬৫ সালে এবং সেই বছরেই আমি
কেন্দ্রীয় সরকারের অডিটর পদে নিযুক্ত হই। এবং ষাটের দশক থেকেই আমার
গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু। আমার অফিসটা একটা বিচিত্র অফিস ছিল। সেখানে
গোটা কলকাতার এমন কোনো দল ছিলনা যার ডিরেক্টর বা নাট্যকর্মী আমার
অফিসে কাজ করতেন না বা আসতেন না।
প্রশ্ন – কোন অফিস?
ডঃ শুভ জোয়ারদার – এ জি বেঙ্গল। প্রথমে যেমন বিভাসদা মানে বিভাস চক্রবর্তী আমার কলিগ ছিলেন।
জ্যেষ্ঠপুত্রের নাটককার তরুণ ঘটক, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনকার
দিনে পি এল টি, বহুরূপী, নান্দীকার, থিয়েটার ওয়ার্কশপ ইত্যাদি সমস্ত গ্রুপের
সাথেই আমাদের জানাশুনো, এবং আমার বন্ধুবান্ধব। আমি তখন থিয়েটার
ওয়ার্কশপের অ্যাসোসিয়েট মেম্বার, এরকম একটা অফিসের মধ্যে ঢুকলাম সেটা
একদমই অফিস না, গোটা অফিস্টাকে দেখলে মনে হবে একটা ইউনিভার্সিটি। শুধু
থিয়েটার নয়, সাহিত্য, খেলাধুলার জগতের যেমন কাবাডি, হকি, ক্রিকেট, ফুটবল,
ভলিবল বাস্কেট বল সমস্ত খেলাধুলার ডিপার্টমেন্টের প্লেয়াররা, আম্পায়াররা,
রেফারীরা, ইন্টারন্যাশনাল কুস্তুগীরদের রেফারীরা, লেখক সব আমার অফিসের লোক। মানে অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখতাম কোনো রকমের কিছু দরকার হলে,
আমার অফিস থেকে তার রেফারেন্স পাওয়া যাবে। এবং সত্যি কথা বলতে কি
আজকে এই কথাটা অকপটে স্বীকার করতে বাধা নেই বা দুঃখ নেই, আমাদের
মতো এই একটি অফিসে যদি আমি না ঢুকতাম তাহলে বোধহয় এত দ্রুত শিক্ষিত
এবং পরিণত আমি হতাম না।
একটা মানুষকে সমৃদ্ধ করে ঋদ্ধ করে, পরিণত
করে, কাজ আর প্রয়োগের অভিজ্ঞতা। তত্বতে কিছু হয় না, প্রয়োগ করেই, সেই
প্রয়োগ সঞ্জাত যে জ্ঞান বা তথ্য সেটা আরো পরিপুষ্ট হয়ে মানুষ অনুভব করে
যখন, তখন সে তাত্বিক হয়ে ওঠে। আমরা প্রতি মূহুর্তে ঐ তথাকথিত অভিজ্ঞতা
গুলো পুষ্ট করতে পারতাম। আমি থিয়েটার কমিউনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
নীলকণ্ঠ, আমি তরুণ ঘটক, সন্টিদা মানে শোভন ঘোষ, আমরা ফার্স্ট প্রোডাকশন
বিভুর বাগ থেকে আছি। আমি যেটা বলতে চাইছি এই হল আমার থিয়েটার
ব্যাকগ্রাউন্ড। তারপরে অফিসে চাকরি করতে করতে আমি ন্যাশনাল স্কুল অব
ড্রামা, দিল্লীতে চলে যাই। অফিসে লিয়েন নিয়ে। মানে আমার খালি চাকরিটা
থাকবে, কিন্তু মাইনাটা আমি পাব না। আমাকে অফিসিয়ালি ছুটি না ছাড় দেওয়া
হবে। কিন্তু সেটা সরকারী হতে হবে। তাদের ওখানে পড়তে যাচ্ছি এই কাগজ
আমার অফিস নিয়ে, সেই ভাবে আমি এন এস ডি থেকে পড়াশুনা শুরু করেছি।
৮৫ নাগাদ। সম্ভবত সেকেন্ড বা থার্ড ব্যাচ। তখন বিভিন্ন সংস্থার কাছে ফর্ম
যেত, আমাকে খবরের কাগজ থেকেই পাঠিয়েছিল।
আমি তখন যুগান্তরে রেগুলার
কাজ করি। আমি অমিতাভ চৌধুরীর হাতে তৈরি করা ছেলে। সাংবাদিক হিসেবে।
এবং আমার ছড়ার খাতা পড়ে উনি আমাকে রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সত্যি কথা বলতে কি গ্রুপ থিয়েটার বলতে যেটা বোঝায় সেটা আমি গ্রুপ
থিয়েটার চর্চার মধ্যে পাইনি, এক। না পাওয়ার কারণ হছে আমার অফিসে
থিয়েটার চর্চার গোটা একটা রহস্যটা বা তার ভেতরের যে আভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা
অথবা অসুবিধেগুলো আমার চোখে, পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল, দুই। গ্রুপ থিয়েটার
চর্চার মধ্যে কিছু অসুবিধা আছে, কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক, মধ্যবিত্তসুলভ অসুবিধা আছে,
দল ভাঙ্গাভাঙ্গি আছে। এসবগুলো আমার চোখে পড়ে গিয়েছিল। চাকরি করছি,
এবং ৬৫ সাল তার পরে এল ৬৮ সাল। আমি যখন চাকরিটা করছি তার আগেই
কিন্তু আমি কলকাতাতে এসেছিলাম। খরদহ থেকে কাঁকুড়গাছি মানিকতলা মানে পূর্ব
কলকাতার যে অঞ্চল, সে অঞ্চলে আমি যুব শাখাটা দেখাশুনা করতাম। অবিভক্ত
কমিউনিস্ট পার্টির। এবং ৬৮ সালের পর দলেতে প্রশ্ন করার জন্য আমাকে, দল
থেকে বিতাড়িত করা হয়। মানে আমি বহিষ্কৃত হই, এবং সেই সময়ের নকশাল
বাড়ির যে আন্দোলনের যে ঢেউ, সেই ঢেউয়ে অবগাহিত না হয়ে অন্তত, এইটুকু
বলা যায় সেই ঢেউয়ের অভিঘাত আমার মননে অত্যন্ত তীব্র একটা শ্রমিক শ্রেণীর
মেহনতী মানুষের বা শ্রমজীবী মানুষের ভারতীয় মানুষের দারিদ্র, দুখদুর্দশা বা
ব্যাথার, আমাকে অনুভব করতে শিখিয়েছিল। কিন্তু একটা কথা, আমি একথা
বলতে বাধ্য হচ্ছি। নকশাল আন্দোলন বলতে সকলে যে মুড়ি মিছরির মতো এক
করে ফেলে। নকশালবাড়ি আন্দোলন কিন্তু একটা নয়, নকশালবাড়ি আন্দোলনে
চারুবাবু এবং সি পি আই এল এল বলে একটা দল ছিল, তার বাইরেও অনেক
গোষ্ঠী ছিল যারা এই রাজনীতিকে সমর্থন করতেন, আমরা সেরকমই একটা
ফ্র্যাকশান ছিলাম যারা, ব্যক্তি হত্যা বা সঙ্ঘাতের রাজনীতি যারা নীতিগতভাবে
বিরোধিতা করতো, এবং সি,পি,আই,এম,এলের মধ্যে আর একটা ব্যপার ছিল যে
ওরা কিন্তু এই গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলোকে না করলেও চলবে এরকম একটা কথা
বলেছিল। আমরা কিন্তু সে তত্বে বিশ্বাস করতাম না।
আমি রাজনীতিটা
শিখেছিলাম, যে মানুষের সাথে থেকেই মানুষের মঙ্গল করতে হবে, মানুষের থেকে
আমি বেশী বুঝি এই দাবী করে মানুষকে কিছু না বুঝিয়ে আমি এগিয়ে যাব আর
মানুষ আমার পেছনে আপনা আপনি যাবে, এটা বিশ্বাস করি না। এবং যে কারণে
আমার বিশ্বাস যে আমাদের রাজনীতি তাত্বিকভাবে সঠিক হলেও কৌশলগত ভাবে
ভুল ছিলো বলেই আমাদের পিছনে জনগন আসেনি, এবং আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
এটা আমার বোধের ব্যাপার। এই জন্য আজ যে সারা জীবন আমি কবিতা লিখি,
আমি গান গাই, আমি পুতুল নাটক করি, আমি যখন ছবি আঁকি আমার যেন
মনে হয় আমি আসলে একটা গানই লিখি, একটা কবিতাই লিখি। একটা কথাই
বলছি। বিভিন্ন কথা বলছি না। আঙ্গিক পাল্টাচ্ছে, হয়তো ছবি থেকে পুতুল হয়ে
যাচ্ছে, পুতুল থেকে সিনেমা হয়ে যাচ্ছে সিনেমা থেকে ছড়া হয়ে যাছে, কিন্তু কথা
কিন্তু সেই একটাই বলছি। এটা আমার মনে হয়। তো যাইহোক। এই হচ্ছে আমার
তথাকথিতভাবে, নাট্য বোধের প্রেক্ষাপট। যে প্রেক্ষাপট থেকে আমি নিজেকে
নাট্যকার বানিয়েছি, কবি বানিয়েছি।
এন,এস,ডি থেকে চলে এসে আমি আমার
রুটি রুজির কাজে লেগে গেলাম, সাথে পেশাদারি ভাবে বিভিন্ন গ্রুপে কাজ করতে
লাগলাম। কোথাও নাট্যকার, কোথাও সুরকার। মানে আমি পয়সা নিয়ে কাজ
করবো, কোনো গ্রুপ ট্রুপের মধ্যে নেই। এটা এই মধ্য আশির দশক। তখন
পদাতিকে ইন্টারন্যাশানাল ডান্স এন্ড থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল হয়েছিল। সেখানে সারা পৃথিবী থেকে নাটকের ডিরেক্টররা, ডান্সের ডিরেক্টররা, পারফরমাররা, এবং
ভারতেরও এ বিষয়ের বিদগ্ধ জনেরা, তারা এলেন, সপ্তাহ ধরে লা মার্টিনিয়ার
স্কুলের মাঠে দিনের বেলা সারাদিন ওখানে ওয়ার্কশপ সেমিনার হত, আর রাতের
বেলা কলামন্দিরে তার পারফরমেন্স হত। সেইখানে একবারে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের
মতো বাতাবরণ, এই দেখছি, মোহন আগাসে, ওই দেখছি অমল পালেকর, সেই
দেখছি সুরেশ দত্ত, এদিকে দেখছি রুদ্র প্রসাদ। তারপরে দেখছি বেনেভিচ, ইত্যাদি,
মানে সারা নোয়েন- আমেরিকান ডান্সার ছৌ নাচছে, সাড়া পৃথিবীর সমস্ত
কালচারাল সেলিব্রিটিরা এক হপ্তা ধরে হুড়োহুড়ি করছে আর সেটা অমিতাভ দা
আমাকে কভারেজ করতে পাঠিয়েছে, গোটা ফেস্টিভ্যালটা কভার করবো আমি।
সেইখানে আমি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় নাট্য ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত
হলাম। সেখানে সুরেশ দত্ত তাদের মধ্যে একজন, যিনি হচ্ছে একজন আন্তর্জাতিক
পুতুল নাট্য ব্যক্তিত্ব। সেই সময় কলকাতা পাপেট থিয়েটারের কর্ণধার। এবং
রাশিয়ার স্যার জোভের শিস্য, পুতুল নাটক শিখে এসেছেন। এসে ক্যালকাটা পাপেট
থিয়েটার করেছেন। সেখানে উনি আমাকে বললেন-আপনি কি আমার সঙ্গে
আসবেন? আমি বললাম আপনি কি করেন? উনি বললেন- আমি পুতুল নাচাই,
এর আগে এই সম্পর্কে আমার সেরকম কোন ধারনা ছিল না।
এন এস ডি তে
যাবার আগে আমি একদিন রবিবার স্টারেতে ওনার একটা শো দেখেছিলাম,
আলাদিন। তা উনি যখন বললেন আমি রাজি হলাম, কারণ সবাটাইতো থিয়েটারের
কাজ। থিয়েটারের অংশ। নাটক হল তিলোত্তমা শিল্প, এবং পুতুন নাটকে সেটা
আরো বেশী কারিগরি নির্ভর। আমি বললাম আমাকে কি করতে হবে? উনি
বললেন আপনাকে পুতুল নাচের কিছু করতে হবে না, আমি তো হতাশ হলাম,
বললাম তালে? উনি বললেন আপনি একজন পেশাদার লেখক, আপনি পুতুলনাচের
মতো করে নাটক লিখে দেবেন এবং সুর করে দেবেন। সেই কাজে লেগে পড়লাম।
সেই যে আমি নাট্যপাড়া থেকে পুতুল নাট্যপাড়ার দরজা দিয়ে ঢুকলাম তার
ঘরেতে, আজও আমি সেই ঘরেতেই রয়েছি, এবং পুতল নাচের ভেতরে যে রস বা
আভ্যন্তরীণ যে শৃঙ্খলা আমাকে খুব টানে। এবং নাটকের থেকে বেশীই টানে, বরং
নাটক যেখান থেকে শুরু করেছিলাম আমরা, সেখান থেকে ইদানীং যারা নাটক
করেন, তাদের আমার খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না। আর পুতুল নাটকের পাড়াটা
হচ্ছে এই রকম, এখানে এত বেশী শিক্ষিত লোকের অভাব, বোধহয় সেইজন্যে
এতদিন টিকেও আছে। তথাকথিত শুদ্ধতা থেকে। অথচ এত বেশী ধন সম্পদ
আছে যে এখান থেকে বেড়োনো মুশকিল। আর প্রতিযোগিতা নেই। এর বৈভব
নাটকে থেকে অনেক বেশী। কারণ পুতুল নাটকের সাহায্যে জনগণকে সচেত্নতার
কাজে এত শক্তিশালী যা নাটকের থেকে অনেক বেশী পেনিট্রেট করে। এই আমার
কাজের কথা।
প্রশ্ন – ডক্টরেট করেছেন কোন বিষয়ে?
ডঃ শুভ জোয়ারদার – আমাকে যখন যুগান্তরে ডেকে নিয়ে গেলেন, আমি তো অডিটে ছিলাম, কেন্দ্রিয় ও রাজ্য সরকারের সমস্ত হিসাব চেক করাই আমার কাজ ছিল, কখন রায়গঞ্জ
কখনও বালুরঘাট, মেদিনিপুর কোচবিহার সর্বত্র যেতে হোত, যখন অখানে যেতে
হত, তখন অমিতদাকে বলতাম যে আমি তো বাইরে চলে যাচ্ছি, অখানে গিয়ে কি
লেখার কাজ আর কি করবো? বললেন কেন? গিয়ে কি সবসময় কলম পিষবে?
যখন যা খবর পাবে আমাকে পাঠিয়ে দেবে আমি ছেপে দেব। হপ্তায় তো বাড়িতে
আসতাম তখন তার কাছে সে সব দিয়ে যেতাম। আমি চাকরি করতাম না
সেখানে, ফ্রিল্যান্স ছিলাম। সেই থেকে আমি জেলার নাট্য তথ্য সংগ্রহ করতে আরম্ভ
করলাম। কিভাবে শুরু হয়েছিল, কোথায় প্রথম ইত্যাদি। আমার রিসার্চের বিষয়
ছিল, ক্রোনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অব বেঙ্গলি থিয়েটার, রুরাল ডিস্ট্রিক্ট
ওয়াইজ। আমাদের বাংলা নাটক তো আরো প্রাচীন, ব্রিটিশরা এসেছে এদেশে ১৭৫৭
সালে পলাশির যুদ্ধ হয়, তার আগেই। তার আগেই কলকাতাতে দুর্গ তৈরি হয়েছে।
যে কারণে সিরাজদৌল্লা কামান টামান নিয়ে ছুটে এসেছিল, এবং ইংরেজরা
ফলতাতে পালিয়েছিল। সেই সময় তারা প্লে হাইস বা থিয়েটার হাইস তৈরী
করেছিল। এবং সিরাজদৌল্লার কামানের গুলিতে তাদের কিছু ক্ষতিও হয়েছিল,
ইংরেজদের ইংরাজি থিয়েটার দেখে তৎকালীন নব্য শিক্ষিত বাঙালি বাবুরা ইংরাজি
থিয়েটারকে কপি করে তারা থিয়েটারটা প্রথম চালু করলো। আমাদের যে বাংলা
থিয়েটার হল তা থিয়েটারকে কপি করে নাটককে কপি করে না। এবং তার
ইতিহাস হচ্ছে দুশো বছরের, তা সেই থিয়েটারের চর্চাই এই আজকে চুইয়ে চুইয়ে
এসে আজকের এই তথাকথিত গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। ঐ থিয়েটারের সাথে এই
থিয়েটারের যোগ আছে। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যময় যে ভারতীয় নাটক, থিয়েটার
নয়। সেই নাটকের সাথে আমাদের থিয়েটারের কোন সম্পর্ক নেই। এবং যেহেতু
আমাদের একটি, থিয়েটার একটি সংস্কৃতি, সে দেশের মৃত্তিকার বাতাবরণের
আবহাওয়ার মধ্যে বেড়ে ওঠে, বিদেশী বীজ যেমন দেশের মাটিতে ফসল ফলায়
না, ঠিক সেইরকম আমাদের সংস্কৃতিকে নন্দিত করতে গেলে, আমাদের মননকে
সমৃদ্ধ করতে গেলে, আমাদের যে সংস্কৃতি আমাদের যে ঐতিহ্য যে আমাদের
থিয়েটার, নাট্য ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে হতে পারেনা।
প্রশ্ন – তাহলে আপনি থিয়েটার বা নাটক কিভাবে ডিফাইন করবেন?
ডঃ শুভ জোয়ারদার – এটাকে এভাবে বলা ভালো, এই যে ইংরিজি শব্দগুলো আমরা পরে শিখেছি। ধরে
নিলাম আমি ইংরিজি জানিনা, তাহলে কি আমরা নাটক করবো না? এক। দুই
হচ্ছে আমাদের নাটক বা বোধ সে তো আমাদেরই। সেটা যেখান থেকে শুরু
হয়েছে সেই জায়গা থেকে যদি আসি, তাহলে এইভাবে এটাকে বুঝতে হবে, যে
পরের দিকে যারা এসেছেন তারা সবই ফরেনার। তারা পরে কবে তারা এক
টাকার দলিল পেয়ে আমাদের লোক হয়ে গেছে, সেটা ইতিহাসের তথ্য, কিন্তু
অরিজিন্যাল, যারা সন অব দ্যা সয়েল, যারা মাটির মানুষ। ভূমিপুত্র। তাদের
কথা তো আগে বলতে হবে। তা তাদের কথা বলতে গিয়ে এইটাই বলবো যে,
ভারতবর্ষে নাটকের একটা প্রাচীন ঐতিহ্য ছিল, অন্তত কমকরে ৫০০০ বছর
আগেকার। জানতে হবে বুঝতে হবে। তারপরে তর্ক করতে হবে। আরো পরিস্কার
করে বললে, ভারতবর্ষে আর্য আগমনের আগেই পূর্বাঞ্চলের গঙ্গারীড অঞ্চলে যাকে
রাঢ় বাংলা বলা হয়, একটি প্রাগার্য বা অনার্য সভ্যতা ছিল, তারা শিল্পে সাহিত্যে
নাটকে নৌবিদ্যায় বাণিজ্যে যুদ্ধ বিদ্যায় একটা সমৃদ্ধ জনপদে বাস করতো। সোনার
বাংলার কনসেপ্ট সেইখানে।
সারা পৃথিবীতে এই সময়টা দেখা যাবে যে ইংরেজরা
আমেরিকা তো জন্মই হয়নি, ইংরেজরা বনে বনে ঘুরছে। এই সময় দেখা যাবে
যে, তাম্রলিপ্ত থেকে তামা সারা পৃথিবীতে প্রথম তামা আবিষ্কার এবং প্রচলন
করেন এই গঙ্গারীড অঞ্চলের অনার্যরা। সেই তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে পাল তোলা
জাহাজে গুজরাট হয়ে, মিশর হয়ে, ইউরোপে বা গ্রীসে পৌঁছে যেত। এবং সেই
পাল তোলা জাহাজেরই তামা সম্ভারের সঙ্গে, আরো যে সমস্ত জিনিস যেত, তার
মধ্যে রেশম আছে, সুগন্ধি মসলা আছে, খেলনা পুতুল আছে, পুতুলনাচ আছে,
ইত্যাদি এমনকি গণিতের শূণ্য কনসেপ্টও ওখানে আছে। এবং ঐ বাঙালিরাই,
অবশ্য বাঙালি কিনা জানিনা, অন্তত বাংলা থেকে যেত বলে বাঙালি বললাম,
ওই অনার্য জাতির প্রতিনিধিরা, বণিক এবং নাবিকরা এমন কি মাতৃ পুতুল, প্রথম
পুতুল কিন্তু মেয়ে পুতুল। আমি বলতে চাইছি মানুষ যখন কোথাও যায় তার
সংস্কৃতিটা নিয়ে যায়।
প্রশ্ন – আমাদের এই পুতুল নাচ কি ভারতীয়?
ডঃ শুভ জোয়ারদার – তাহলে যে সংস্কৃতিটা ওই পাল তোলা জাহাজে করে ৫০০০ বছর আগে মিশরে চলে
গেল, এবং তাদের কেউ কেউ সেখানে থেকে যেত, কেউ ফিরে আসতো, আর
সেই সুবাদে তাদেরও সংস্কৃতির সাথে নাচ গান নাটক ও হতে লাগলো আর তার
উৎস হল এই ভারতীয় লোকনাটক। বঙ্গদেশীয় লোকনাটক। আর তা থেকেই
তৎকালীন পুতুল নাটকের চর্চা ও জন্ম । এখন পুতুল নাটক আগে না নাটক
আগে এ বিতর্কের অবসান এখনও হয়নি, পণ্ডিতরা এখনো গবেষণা করছেন,
সিদ্ধান্ত হয় নি। তবে একটা কথা বলাই যায় যে দুটোই প্রায় সমকালীন। এবং
ভারতীয় নাটক বা লোকনাটক আর পুতুল নাটক, ভারতীয় নাটকই ইউরোপীয়
নাটকের জননী, আবার ভারতীয় পুতুল নাটকই সারা পৃথিবীর পাপেট্রির জননি।
পূর্ব ভারতের গঙ্গারীড অঞ্চল হচ্ছে লেখা আছে ইংরেজি ছাপা অক্ষরে, যে
মাদারল্যান্ড অব ওয়ার্ল্ড পাপেট্রি। অতএব আমাদের বর্ণময় ঐতিহ্যময়।
প্রশ্ন – এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কি নাটকের মতো এই পুতুল নাটককেও
অনুদান দেওয়া হয়?
ডঃ শুভ জোয়ারদার – অবশ্যই হয়। পুতুল নাটকের ট্র্যাডিশনাল দল্গুলোকে অনুদান দেওয়া হয়। টোবে
আমী এতা বিশ্বাস করি না যে অনুদানে কোন নাট্যচর্চা বা শিল্প চর্চা বেঁচে থাকতে
পারে। বরং উল্টোটাই দেখেছি, অনুদানমুখী কিছু দল গড়ে উঠেছে। চর্চা হচ্ছে,
যাদের কাজই হচ্ছে অনুদানটাকে পকেটে পোরা। কিন্তু এই শিল্পের মাধ্যমে জনগনের
মঙ্গল করার চর্চা আমি অন্তত চোখে দেখিনি। আমরা হয়তো তাত্বিকের দিক থেকে
ঠিক আছি, কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে কাজটা করছি না। আমাদের এখানে দু
ধরনের দল আছে, একধরণের দল হচ্ছে অনিদান পেয়ে তাদের নিজেদের কাজে
লাগায়, আর একদল অনুদান না পেয়েও নিজেদের কাজ করে যায়। তার উন্নতির
জন্য আপ্রান লড়ে যাচ্ছে। আর সেই চর্চা আর লড়াই তাদের আরো উন্নত করছে,
সেখানে পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। আসল কথা হচ্ছে আমি যে আর্ট ফর্মটা
শিখেছি, সেটা মাটির থেকে শিখেছি, সমাজ থেকে শিখেছি, তাই সেইটাকে আমি
তাদের কাছে কতটা পৌঁছে দিতে পারছি। কি পেলাম আর পেলাম না সেটা না
দেখে উদ্দেশ্যটা পরিস্কার হোয়া দরকার। কিন্তু এইজায়গাটায় কেউ পরিষ্কার নয়।
কেউ না। এই সত্তর বছর কাটিয়ে দিলাম তবু মনে হল আমি এখনো কিছু
শিখিনি, এখনো শিখছি। আর এখানেই একটা কথা আসে আমি যদি এই
মাধ্যমটাকে মানুষের কাজে ব্যবহার করতে চাই তাহলে আমাকে সৎ হতে হবে।
আর আমাদের সংস্কৃতি জগতে সৎ লোকের বড় অভাব। আপনি সাহায্য নিন,
কিন্তু উদ্বৃত্ত কে আত্মসাৎ করাটা ঠিক নয়। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে আপনার নৈতিকতা
হারাচ্ছেন।
প্রশ্ন – এ থেকে আমাদের মুক্তি কোথায়?
ডঃ শুভ জোয়ারদার – আমি একটা কথা এখানে বলি খুব, থিংস আর ভেরি সিম্পল, উই দ্য পিপল মেক
ইট ভেরি কমপ্লিওকেটেড। আমি যখন এই অস্বাস্থকর দুর্নীতিগ্রস্থ পরিবেশের মধ্যে
বসবাস করছি তবু এর মধ্যে থেকেও প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারণ করা যায়। ইউনেস্কো
থেকে রিপোর্ট আছে যে ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় দেশগুলোতে টাকা পয়সা কোন
সমস্যা নয়, মূল সমষ্যা হচ্ছে অসচেতনতা, যেটা নিয়ে তুমি কাজ করো। সংস্কৃতি
বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন পুতুল নাটক হচ্ছে, ভারতের এমন শিল্প কলা যার সাহায্যে
মানুষের সচেতনতার কাজে এক নম্বর ওয়েপন। পুতুল নাটকই শ্রেষ্ঠ আয়ুধ। তাহলে
প্রশ্ন আসে পুতুল নাটকই যদি মানুষকে সচেতন করতে সারা পৃথিবীতে একমাত্র
প্রধান মাধ্যম হয় তাহলে আমরা কেন সেটা ব্যবহারে সচেষ্ট হচ্ছি না? একটা তথ্য
দিতে হবে আমাদের এই পম্পরার পুতুল নাচ সরকার কতৃক রেয়ার, মৃতপ্রায়,
মুমূর্ষু হিসেবে ঘোষিত হয়ে গেছে। এ অধিকার কার আছে? আমি মনে করি
লোকসমাজেরই আছে, আর কারো নয়। এটা লোক সংস্কৃতি মানুষের। এর থেকে
একে উজ্জীবিত করে কনটেম্পোরারি পাপেট্রির চর্চা চলছে। মুক্তির সূত্র এখানেই
আছে। আর এর সাথে বাবুবিলাসী নাট্যের বাতানুকুল চর্চা সমাজের কি কাজে
লাগে? খায় না গায়ে মাখে? কোনটা থাকবে আর কোনটা থাকবেনা সেটা মানুষ
ঠিক করবে, সময় ঠিক করবে। আর আমিও তাই এই কথাগুলো আমার তুলিতে,
কলমে বলেই যাব বলেই যাব, কারণ এ ছাড়া আমার আর কোন কাজ নেই। বঙ্গ
পুতুল সেই কাজ করে চলেছে।
প্রশ্ন – প্রজন্মের জন্য বার্তা কি?
ডঃ শুভ জোয়ারদার – নাটকই হোক বা পুতুল নাটকই হোক সেটা তো সমাজের একটা অনিবার্য প্রকাশ
ভঙ্গিমা, এই মতিগতি থেকে মধ্যবিত্তদের হাটাতে না পারলে কলঙ্কমুক্ত বা বিপদমুক্ত
হবে না। আমিও মধ্যবিত্ত। আমার নিজের মুখোশ আমি নিজেই খুলবো। এই ফলিত
শিল্প থেকে মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগীদের যতক্ষণ না বিচ্ছিন্ন করা যাবে ততক্ষণ এই
কর্কট রোগ থেকে রেহাই নেই। উপায়? একটু নিজেকে ডিক্লাসড করা আর
তথাকথিত কম বোঝা বা দীনের কাছে পৌঁছে যাওয়া।