Theatre: মাচার মানুষের জন্মদিনে একটি মনোজ্ঞ সন্ধ্যা

- Advertisement -

দেবা রায়, কলকাতা

সম্প্রতি কলকাতায় বি- থিয়েটারে (Theatre) নিরঞ্জন সদনের মিনি হল দর্শকে পূর্ণ ছিল। আজও বিনোদিনীরা রয়েছেন আমাদের থিয়েটারের (Theatre) প্রকোষ্ঠে তারই সাক্ষ্য এই সন্ধ্যা।

মাচার মানুষের শুভ জন্মদিনের এই আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করেছে। কত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে যে একটা নাটক (Natok) নির্মাণ সম্ভব হয় সেটা একমাত্র যারা থিয়েটার করেন তাঁরা ছাড়া খুব কম মানুষই বোঝেন। মাচার মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে বেশ ভালো ভালো নাটক আমাদের উপহার দিয়ে চলেছেন। 

তাঁদের এই বিশেষ দিনে চার বিনোদিনী এক হয়ে মঞ্চে প্রমাণ করলেন তাঁদের দক্ষতা ও নিষ্ঠা। ‘না-আমি’ দিয়ে শুরু হল নাটকের পর্ব। নারী ধারাবাহিক যন্ত্রণার কথা এক কাব্যিক লহমায় উপস্থাপিত হল। সার্বিকভাবে নাটকটাতে পুরুষের দিকে আঙ্গুল তোলা মনে হলেও সত্যানুসন্ধানে তা কখনই অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়নি। বিনোদিনী-সুচরিতার কন্ঠ ও লেখনী যেন মঞ্চে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই নাটকের আবহে ক্লাসিক্যাল কণ্ঠের প্রয়োগ অসামান্য। সাথে সৌমেন চক্রবর্তীর আলো আর সোহমের মঞ্চ নাট্য মঞ্চায়নে পূর্ণতা দিয়েছে। 

দ্বিতীয় বিনোদিনী কল্পনা বড়ুয়া। যিনি তাঁর দল কল্পনা থিয়েটার ফর কজ এর পক্ষ থেকে অভিনয় করলেন গান্ধারী চরিত্রে। সেই চিরায়ত বিতর্কিত ও বহু চর্চিত গান্ধারী চরিত্র চিত্রায়ণে সত্যি বিনোদিনীর সার্থকতা বজায় থেকেছে। দর্শকের মধ্য থেকে গান্ধারী বা অন্যান্য চরিত্রের প্রবেশ ও প্রস্থান নাটককে দর্শকের মাঝে স্থাপন করেছেন।

বিনোদিনীর তৃতীয় রূপ ‘কুষ্ট রোগীর বউ’ রূপায়িত করলেন ঋতুপর্ণা বিশ্বাস আমতা পরিচয়ের পক্ষ থেকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে রচিত এই নাটক। অভিনয়ের বলিষ্টতা, বাচিক-কায়িকের একক অভিনয় আমাদের মুগ্ধ করে রাখে। সার্থক বিনোদিনী নাম। মঞ্চে একটি দড়ির ব্যবহার বা আরাম কেদারার ব্যবহার নাট্য নৈপূন্যের প্রকাশ, তাদের এক একটি চরিত্র করে অভিনয়ের দক্ষতা অসামান্য দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন।

চতুর্থ বিনোদিনী আলোকপর্ণা গুহ, যার শ্রম শুধু তাঁর নিজস্ব অভিনয়ে সীমায়িত থাকেনি, এ নাটক একটি টীম ওয়ার্ক, সকলকে নিয়ে একটা পূর্ণ নাটকের চেহারা নির্মাণ করতে সফল হয়েছেন এই বিনোদিনী থিয়েটার পুষ্পকের পক্ষ থেকে। 

বিনোদিনীদের এইভাবে এগিয়ে নিয়ে আসা বর্তমান নাট্য চর্চায় একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে। নিশ্চই আগামীদিনে আরো বিনোদিনীরা যুক্ত হবেন এই পরিসরে। এবং এই পদক্ষেপ একটি যথাযথ পদক্ষেপ বলেই আমি বিশ্বাস করি। 

শুধু একটা প্রত্যাশা থেকে যায় এই বিনোদিনীরা সময়ের কথা আগামীতে তাঁদের নাটকে বলবেন তো! সেই বিনোদিনীর যন্ত্রণা আর আজকের বিনোদিনীর যন্ত্রনা যা সবসময় পুরুষকে নির্দেশ করে না। মাঝে মাঝে রাষ্ট্রিক চক্রান্তকেও একটা গভীর প্রশ্ন তোলে। নারীকে সংরক্ষণের গোত্রে ফেলা যতনা পুরুষের দায় তার চেয়ে অনেক বেশী দায় বা চক্রান্ত রাষ্টযন্ত্রের যা শুধু পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রকাশ করে না ক্ষমতার একনায়কত্ত্বকেও নির্দেশ করে। 

বিনোদিনী পর্যায়ের সঞ্চালনা করলেন সুলক্ষণা সাহা চক্রবর্তী। বিনোদিনী পর্যায় বলার কারণ আমি চার বিনোদিনীর নাটক দেখলাম এক বিনোদিনীর পরিসরে। সঞ্চালিকা নিজেও নিজেকে আগামীদিনে এই বিনোদিনীদের মাঝে স্থান পেতে চেয়েছেন। প্রতিটি নাট্যের অন্তরবর্তী অন্ধকার সেই ঐক্যকেই নির্দেশ করেছে বলে মনে হয়েছে। চারটি নাটক মানুষ স্থির হয়ে বসে দেখেছেন।

বিনোদিনী পর্যায়ের আগে শান্তনু সাহার একটি তথ্য চিত্র দেখানো হয়েছে। যা নাট্যজ্ঞ বিভাস চক্রবর্তীর নাট্যকর্মের আলেখ্য। বিহাইন্ড দা কার্টেন- আ জার্নি উইথ বিভাস চক্রবর্তী। 

নাট্যকার নির্দেশক বিভাস চক্রবর্তীর নাট্য জীবিনের খোঁজে নির্দেশক শান্তনু সাহা একটি অনবদ্য জীবন আলেখ্য নির্মান করেছেন। তথ্যচিত্রটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ের আবর্তে বিভাসবাবুর কর্মজীবিনের নানান কথা একটা ছন্দময় বাক্যালাপের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। একদিকে বিভিন্ন নাট্যকারের, নাট্য ব্যক্তিত্ব যেমন মোহিত চট্টোপাধ্যা, মনোজ মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের বয়ান পাশাপাশি তাঁর কাজের চিত্ররূপ বেশ সাবলীল পরিবেশ তৈরী করেছে। নাট্যকার নির্দেশক অভিনেতা বিভাসবাবুর বহুমুখী প্রতিভার কথা এই তথ্যচিত্রে প্রতিভাত হয়েছে।

তথ্যচিত্রটির একটি সুন্দর দিক এটি ইতিহাস তথা সময়ের তৎকালীন ঘটনাবলীর নিরীখে আখ্যায়িত হয়েছে। তথ্যচিত্রের আরও একটি গুণ, এর বুনন নৈপূণ্য। একটি তথ্যচিত্রের উপস্থাপনায় কখনোই কোনও শৈথিল্য দেখা যায় নি, দর্শক এক ঘন্টারও অধিক সময় ধরে পুরো ছবিটা দেখেছেন। তথ্যচিত্রের এই গতিময়তা নির্মাণ দক্ষতাকেই নির্দেশ করে। ভিন্ন নাট্যজনের ইন্টারভিউ সাধারণত তথ্যচিত্রটি দেখতে একঘেয়ে হয়ে ওঠে, এক্ষেত্রে নির্দেশক খুব সুন্দর টাইম স্পেসের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে বক্তাদের সংলাপকে বার বার এক নাট্য প্রক্রিয়ার ঢঙ এর গড়ে তুলেছেন। বিষয় ও ভাবনা ছন্দে থাকায় ‘উরাইল বনের নির্জনে’ বা বিহাইন্ড দা কার্টেন শান্তনু সাহার এক সার্থক রূপায়ন।

তবে তথ্যচিত্রে ব্যবহৃত আবহে হিন্দী গানের প্রয়োগ বিষয় আঙ্গিককে মনে হয় ব্যহত করেছে। যদিও সামগ্রিক আবহ নির্মান যথাযথ। সম্পূর্ণ তথ্য চিত্রের ভাষ্যপাঠও খুব সুন্দর। 

তথ্যচিত্রটি ভিডিওগ্রাফি করেছেন চন্দন মন্ডল, সাউন্ড ডিজাইন ও এডিট করেছেন সবুজ কোনার,ভাষ্যপাঠে সুপ্রিয় দত্ত, গ্রাফিক্স- শান্তনু সাহা, প্রযোজক সুলক্ষনা চক্রবর্তী এই নির্মান টীম তৈরী হয়েছে। 

মাচার মানুষে নাট্যদল তাঁদের জন্মদিনেরএই আয়োজন একটি সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দিয়েছে। 

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -