দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা
চারিদিকেই সব মানুষ যেভাবে বিপন্ন, সেভাবেই নাট্যদলগুলিও নানাভাবে বিভ্রান্ত। দেশের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি হাঙরের হা মুখ নিয়ে গিলে খেতে অকস্মাৎ একেবারেই নতুনভাবে সামনে আসছে। প্রতিদিন পাল্টাচ্ছে ভবিতব্য ভবিষ্যৎ। ডিজিটাল ইন্ডিয়া হবার দুঃস্বপ্ন মধ্যবিত্তের তহবিল তছরুপ করছে, আর ব্যাঙ্ক হ্যাকাররা হাহা হাসিতে ফেটে পড়ছে। সেকেন্ডে অ্যাকাউন্টে সিঁদ কেটে ডাকাতি করার এই উল্লাস, জনজীবনে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে।
রোজকার জীবনে ভয়, ভীতি, আর সন্ত্রাসের দুশ্চিন্তা স্বস্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। কেউ জানে না সামনের দিনে কে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। ঠক জোচ্চোর জালিয়াতে ভরে যাচ্ছে পরিবেশ। তবুও মরিয়া প্রতিবেশীদের সবাই। আনন্দিত ভূবণের অনুসন্ধানে পাগল হয়ে নাচছে আর গাইছে “তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো যেতে দেবো না”। এমন অদ্ভুত লালন পীরিতি পরম নিধি আমাদের বাপ দাদাও অতীতে চাক্ষুষ করেননি। যখন বৈরাগ্য বাজারের এক বিশেষ ব্যবস্থায় আমদানি হওয়া এক কমোডিটি মার্কেটের পণ্য মাত্র। তা হোক আনন্দটুকুই ভরসা। ‘তুহু মম শ্যাম সমান’। এভাবেই একদিকে লুটপাট অন্যদিকে লুক্রেতিউস গুহায় আতঙ্কিত প্রহর গুনে সময় কাটাচ্ছে।
কিন্তু এই ভয়ংকর বাস্তবতা নিয়ে কেউ নাটক লিখছেন না, তথাপি নতুন এক বিদেশী সাহিত্যের ছায়া অবলম্বনে বাংলা নাটকের কায়া বেশ গর্বিত ভাবে বাজারে আসছে। নির্দেশকের হাতে ফিল্টার উইলস সিগারেট গুজে দিয়ে মুখে আগুন জ্বেলে দিব্যি আগুনের পরশমণি গান গাইছে। যেন কোথাও কোন সমস্যা নেই। বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে, এমন মাথাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিতেই আসছে শুধুই পলকা চটুল আনন্দঘন একটা সময়, যার পেছনেই ধর্মীয় মৌলবাদের জয়জয়কার। তাই রামের বীরত্বকাহিনি খুব ঘটা করা নাট্য ডিজাইনের মধ্যেই ফাটাফাটি আঙ্গীকে রাবণদের আত্মরক্ষা করে নিজের বিলাসবহুল ফুর্তি নির্ভর জীবন যাপনকেই প্রথম গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। কারণ জগতে আনন্দ যজ্ঞে সবাইকে অভয় দিতেই রাজ্য রাষ্ট্র কোথাও ফাঁক রাখেনি। এদিকে বাস্তব অবস্থা, কেউ কারও প্রতি সহমর্মিতা বা সহানুভূতিতে আন্তরিক নয়।
‘‘রোজকার জীবনে ভয়, ভীতি, আর সন্ত্রাসের দুশ্চিন্তা স্বস্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে ’’
সন্তানের কাছে বাবা মা অতীত এক কর্তৃপক্ষ মাত্র, যারা যা করেছেন অপত্যস্নেহ বসত, তা নাকি পৃথিবীতে সন্তানদের আনার দায় সূত্রে প্রতিপালন। স্ত্রীর কাছে হাজার অবদান রেখেও স্বামী এক শ্রেষ্ঠ বোকা প্রাণী। আবার স্বামীর কাছেও বউয়ের চেয়ে বাইরের ইতর মেয়েরা অনেক বেশি প্রেমাবেগের উৎস। বোঝাপড়াটা তেলে বেগুনে ছ্যাকছ্যাক ছ্যাকড়াগাড়ি, গড়িয়ে চলছে। থামছে না কিছুতেই। ওদিকে ধনী দরিদ্রদের মধ্যে বিভেদ কমে আসছে। সবাই-ই প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন অবস্থায় আরও আরও সুখের তালাস করছে।
এই সমাজের মধ্যেই আছে তো সব নাট্যজন এবং নাট্যকর্মী। কাজেই থিয়েটারে এরাই কর্তৃত্ব করছেন বিভিন্ন বিভাগে। যেখানে সবাই-ই মূল্যবোধের তলানিতে আছে, সেখানে সুচেতনায়, সুচারু শিল্প সামাজিক দায়বদ্ধতা ধারণ করবে কি করে? অতএব সবই চলছে নান জটিলতার মধ্যেই। অনেকের নিন্দা তুচ্ছ করে আপন খেয়ালে কালাতিপাত করে করে।
রাষ্ট্রের কোন দায় নেই দেশের মানুষের প্রতিপালনে। রাষ্ট্র নায়কেরা ধরেই নিয়েছে যা করবো, তাই জনমত মেনে নেবে, মানুষের চেয়ে লোহার দাম বেশি, নেহাত ভোট বলে এক নির্বাচনী সিস্টেম আছে। পাশের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধাক্কা দিতে মানুষ লাগেই, ওই মদের সাথে কষা মাংসে ব্রয়লার মুরগির মতো। শুধু ভোট ব্যতীত মানুষ তাই অর্থহীন জঞ্জাল।
এর মধ্যেই নাটক করে অনেক কৃতি কুশীলব ধনে প্রাণে নিঃশেষ হয়েছেন। কিন্তু সাম্যবাদের পাথর হেলাতেও পারেন নি। কারণ সিস্টেমের গোড়ায় আছে বিষ। সংস্কৃতি একটা গাল ভরা কথা। উন্নয়ন সমৃদ্ধি ফালতু ডাকাতির ছলা কলা। বাংলা নাটকের গৌরব বাড়ুক, তা কি সরকার চায়? কাজেই বিলাতী জীবনে একটা বাঁদর পোষাই এখন নাটকের কাজ। কখনো মাটিতে কখনো গাছে, ভিলেজ কটেজে স্পেস পেলেই লাফঝাঁপ আর কোরিওগ্রাফ মানেই মুহুর্মুহু হাততালি।
নাটকের গতি প্রকৃতি এবং গন্তব্য দিনদিন বিভিধ পথে বিভিন্ন ভাবে বিচিত্র চলনে চলছে। এই চলার কতটুকু অস্তিত্ব-সার আর বুঝতে পারলাম। যে উল্টো পাল্টা কথা বলবো।
আমি আজও জানি না, সমগ্র মানুষের কল্যাণে নাটক কোন জাগরণ এনেছে না আনেননি। এখনও নাটক নদীতে কত জল আর কান্না একসাথে মিশেছে, তার থই পেলাম কই? চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে দেখলাম, এই একটা গোটা জীবন ধরে খুব কাছ থেকে দেখলাম, থইথই স্রোতে চলা নাটকের জোয়ার। কিন্তু তার ভাল মন্দকে কোথায় থুই বুঝতে পারি নি আজও।
মতবাদ, মতান্তর, মতানৈক্য নিয়ে যা চলার তাই চলছে। যথেষ্ট হচ্ছে, অনেক চিন্তিত মতেই মঞ্চে নাটক উঠতে চায়। কিন্তু চিন্তায় বিজন ঋত্বিক উৎপল অজিতেশ বাদল শম্ভুরা কই? নাটকের আকাশে কোন চিন্তায় ভাবনায় আকাশের ওপারের আকাশ বর্তমান? কথা আর কথা, একরাশ মিথ্যা নাটুকে সংলাপ। মঞ্চের সত্য আর জীবনের সত্যে বড়ই গরমিল। আর এখানেই প্রদীপের নিচে আছে ছায়ান্ধকার।
‘‘পসরা সাজিয়ে বিনিময়ে ছোট ছোট পকেটে বিভক্ত হয়ে বিনিময়ে বিনিয়োগের নাটক করছে।’’
এখন কায়দায় বিরোধিতা ক’রে, পেশাদারী থিয়েটারকে ঘৃণা করে, গ্রুপ থিয়েটার বনে আবার থিয়েটারের বাণিজ্যিক চরিত্রে, পসরা সাজিয়ে বিনিময়ে ছোট ছোট পকেটে বিভক্ত হয়ে বিনিময়ে বিনিয়োগের নাটক করছে।
বাদল সরকারের তৃতীয় থিয়েটার, পথ নাটক এখন ভিলেজ থিয়েটার, স্পেস থিয়েটারে ইত্যাদি রূপে অন্য পোশাক পরেছে। সবই চলছে। রমরমা গণনাট্যের মাঝে লোকায়ত চর্চা কোথায় মুখ লুকালো, জানিনা। শুধু বুঝি এখন সেখানে 4G নেটওয়ার্ক চলে। সেকি বুঝতে পারছি? এই কর্পোরেট বিপনি আমাদের কোথায় আবদ্ধ করছে? এক বিশ্ব নায়ক বিজ্ঞানের সহায়তায় সবাইকে এক পথেই ভিখারি করবে।
তাই এবার নিজেকে নিয়েই বরং চুপচাপ ভাবি। কি বললাম, কেন বললাম, কাদের বললাম, বলে কি লাভ হয়েছে, তাই ভাবি না-হয় আজ সারা রাত।
আমার সামনে খালি পড়ে ছিল ইজিচেয়ারটা। নতুন কিনেছি। শিশির ভাদুড়ী কি ভাবনা স্রোতে এসে বসেছেন, ওই চেয়ারে? কাছে গেলাম। স্যার, স্যার, আপনার চোখে জল! আপনি তো আপনার জীবনে এক যুগের মহান নায়ক! এতো স্বীকৃতি, এতো আধুনিক আধিপত্য বাংলা মঞ্চে আপনার ছিল। স্যার, আপনার চোখে জল!
ঠিক আমার বাবা যেন, মুখের অসহায় অসংখ্য শিরায় ঝড় তুলে, উঁচু গলায় বললেন- “থাক থাক, আর বলতে হবে না। স্বীকৃতি! কিসের স্বীকৃতি? আজ এতো বছর নাট্যশালা ছেড়ে বসে আছি। কই, কেউ তো কোনদিন এসে বললেন না– এসো, তোমার নাট্যশালা খুলে দিই? তোমার ইচ্ছেমতো অভিনয় করে যাও। আমার প্রতি দরদ থাকলে, ওই নাট্যশালার প্রতিও দরদ থাকতো, কত তারিখ আজকে? আজ ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫৯ সাল। ওই দেখো, টেবিলের উপর পড়ে আছে, ভারত সরকার আমাকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করতে চায়।
থিয়েটার ভালবাসি। চিরদিনই এই ভালবাসা আছে, থাকবে। বরাবরই তাই নিয়েই আছি। অনেক জ্বালা জ্বলেপুড়ে। কিন্তু হঠাৎ আমাকে সম্মান দেখানোর কি আছে? সম্মান দেখানোর এই ঘটা কেন? কালই ভারত সরকারকে চিঠি লিখেই জানিয়ে দেবো, তোমাদের এ সম্মান আমি চাইনে। ওই পদবি দেবার বদলে যদি, এই কলকাতার বুকে ভাল একটা নাট্যশালা খোলার কথা যদি ভারত সরকার ঘোষণা করতো, তবে…।
– হুঁ তাই করে নাকি! আমার উপর দরদ থাকলে নাট্যশালার প্রতিও দরদ থাকতো। আসলে মিথ্যা এই আদর, একটা ভান, তাছাড়া ওইসব খেতাব, পদবী জিনিসগুলোই ভুয়ো। কোন দাম নেই। শুধু শুনে নাও, নাটক নাটক কর তো, জেনে যাও, এই দেশ নাটকের কদরই বুঝলো না। না সরকার, না জনসাধারণ। কেউ না। কেউ তোমরা স্বীকার করো না, স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে এই নাট্যশালার কত দাম।
‘‘আমাদের দেশ দরিদ্র। বেশি টাকার টিকিট কিনবার সামর্থ্য সাধারণ দর্শকের নেই।’’
যাত্রার আসরে অনাদৃত হয়েই থিয়েটার আমাদের দেশে বহু সংগ্রামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমাদের দেশ দরিদ্র। বেশি টাকার টিকিট কিনবার সামর্থ্য সাধারণ দর্শকের নেই। আলোক প্লাবিত মঞ্চের উপর নয়নাভিরাম দৃশ্য পটের সৃষ্টিতে অনেক খরচ। কিন্তু কি জানো, এর আরো কুফল আছে।
নাট্যের অন্তরে যে অন্তর্গত প্রাণ আছে, তা তো অভিনয়, তা ক’জন মানে, ওরা তার চেয়ে দৃশ্য পটের জাঁকজমকে বেশি মুগ্ধ হয়। কষ্ট পাই এতে নাট্যেত ক্ষতি। যাও যাও… আমাকে একটু একা থাকতে দাও।….”
শিশির কুমার ২রা ফেব্রুয়ারী ভারত সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই উপাধি গ্রহণ করছেন না। গ্রহণ করতে পারবেন না বলেই। এখন কি আর এমন চিন্তা মাথায় কারো জাগবে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা অনেকেই অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু নাট্য জগতে যে যা করতে চাই, যা বলতে চাই, যা বলা উচিত, তা কাউকে করে বা বলে অথবা দেখিয়ে কাউকেই কেউ কিছুই বোঝাতে পারিনি। তাই আমাদের পরীক্ষা আর থিতু হোলো না। চলছে তো চলছেই।
বাংলার সাধারণ মানুষ তাই নাটক থেকে মজা টুকুই ছেঁকে নিয়ে জ্ঞান ফেলে দিয়েছে কলার খোসা ফেলার নিয়মে। আজ আর এতো কচকচিতে তারা নেই। নাটক নিয়ে কেউ আর বাড়াবাড়ি করে না। জানে সবাই। সব ইতিহাস। তাই কি হবে এসব কথা টেনে এনে?
সেই বহুরূপী নাট্যদলের প্রতিষ্ঠা প্রতিজ্ঞায় কতো শত দামী ইচ্ছা ছিল। শম্ভু মিত্র বলেছিলেন —“জীবনকে বুঝবো বলেই শিল্পের দ্বারস্থ হয়ে আশা করি যে শিল্পী তার ব্যক্তি জীবনের দামে জীবনকে যতটা বুঝবে। তারই আলো দিয়ে আমাকে আমার আত্মা খুঁজে পাওয়ার পথে শিল্প সাহায্য করবে। আজকের দিনে বটেই…।
প্রত্যেক যুগেই তাই আমাদের প্রয়োজন এমন নাটকের। জীবন সম্পর্কে অর্থাৎ রিয়েলিটি সম্পর্কে, অর্থাৎ সত্য সম্পর্কে আমাদেরকে উন্নত করবে। গভীর করবে। একদিন আমরা নেশায় পেশায় মিল করাকে সহজ করে তুলবো। তার মানে এই নয় যে পেশার কাছে নেশাকে বলি দেবো।”
কিন্তু আদপে কি দেখলাম? ৯-১২-৭১ তারিখে চোপ! আদালত চলছে নাটকের নির্মাণের পরে, সেই ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি, প্রায় ২৬ বছর জীবিত থেকেও বহুরূপী দলের মূল্যবোধে নাট্যজন বলে পরিগনিত হলেনই না। এটা কত বড় বাংলা নাটকের দূর্ভাগ্য, তা কি কেউ জানি না। তাঁর চেতনা থেকেই সেই ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালে চিন্তিত হয়েছিল…. “আমরা ভাল নাটক অভিনয় করতে চাই। যে নাটকে সামাজিক দায়িত্ব জ্ঞানের প্রকাশ ও মহোত্তর জীবন গঠনের প্রয়াস আছে। দেশের ঐতিহ্যের ভান্ডারে যে সমস্ত সাহিত্য সম্পদ আছে তার মধ্যে নাটক গল্প উপন্যাস ইত্যাদির প্রয়োজন মতো নাট্যরূপ দিয়ে সেগুলিকে অভিনয় করব জনপ্রিয় করে তোলাও আমাদের কর্তব্য মনে করি। আবৃত্তি ও গানের অনুশীলন করে সেগুলো পরিবেশনের বিভিন্ন রূপ আবিস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। এই সমস্ত সুষ্ঠুভাবে করবার উদ্দেশ্যে আমরা বহুরূপী দল প্রতিষ্ঠা করেছি।”
‘‘বিপজ্জনক ভাবে একটা খালের কিনারা ধরে ঝুলে আছি সবাই এই নাটকের জগতে। বেঁচে আছি, এই যথেষ্ট মাত্র।’’
৭৩ কি ৭৫ বছর চলার পরে সেই কিম্বদন্তী দলে তালা ঝুলে গেছে। তাহলে আর কি বলার থাকে? ১৮৮৬ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত, প্রায় ৫৫ বছর ধরে অত্যন্ত ঘৃণিত জীবন যাপন করেছেন নটী বিনোদিনী স্বয়ং। কই পেশাদার রঙ্গালয়ের কেউ তো তাঁকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনেন নি? তাহলে? এদিনও একদিন লম্ফঝম্প করে উবে যাবে। কি থাকবে আমাদের আত্ম স্বার্থ সর্বস্ব এই হাল হকিকতের নাট্য জমানার? কেউ কি ভাবছি সেভাবে কিছু?
হাজার চেষ্টা করেও বাংলা নাটকের জগতে কেউ আদিত্য সফলতার সম্রাট বলতে যা বোঝায়, তা হতে পারে নি। সেই মর্মে যে কাজ করার সংকল্প ছিল, তা আমরা সুসম্পন্ন করতেও পারি নি। মেনে চলেছি, চলেছে নাটক, কিন্তু চলা না সরা তা আজও বোঝা যায় নি। মানুষের কাছে উপকার উপকরণ নিয়ে যাবার পথেই ঘটেছে বিপত্তি। নাটকের চূড়ান্ত সার্থকতা কী, জানি না। সবাই বহু উদ্যোগ উদ্যোম সত্ত্বেও সবভাবে ক্রমাগত হেরে গেছি। বাস্তব অবস্থা, চারপাশের সবার অভিমত, চলার সাপেক্ষে অর্থনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতি,
মোট কথা বিপজ্জনক ভাবে একটা খালের কিনারা ধরে ঝুলে আছি সবাই এই নাটকের জগতে। বেঁচে আছি, এই যথেষ্ট মাত্র। এখন যে অবস্থায় দিকে দিকে স্ক্যাম, শিক্ষা স্বাস্থ্য নিয়ে যে জোচ্চুরি চলছে তার বিরুদ্ধে নাটকে কোন প্রতিবাদ এসেছে? নাটকের বক্তব্য বিষয়ে কে কি কথা বলেছেন? সবাই যেখানে প্রতিষ্ঠানের গায়ে গা মিলিয়ে চলছে, আমার তা করার কোন প্রয়োজন নেই। করনীয় থাকলেও, করা যখন হলো না। তখন বিতর্ক বাড়িয়ে গাল মন্দ নাই বা খেলাম।
জানি জানি, বলতে হবে না। আমি সবই বুঝি। আমি, তুমি সে সবাই যৎসামান্য একজন মানুষ। মাত্র ৫ ফুট ২ ইঞ্চি থেকে ৬ ইঞ্চি উচ্চতার মফস্বল নাট্যকর্মী। নিজেরটা বুঝি। আমার খুব হাঁটুতে ব্যথা। এখন হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়। এতদিনের বিফলে চলে যাওয়া শ্রমের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, অসম্ভব। আর কিছু হবার নয়। সেই সূর্য উদয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া, হবে না এ জীবনে।
কারণ এখন এক অরাজক কারবার সব স্থিতি তছনছ করে দিচ্ছে। কিছুতেই আর তো মাটিতে বেড়ে লতিয়ে সূর্যমুখী হতে পারছি না। পা দুটো এঁটে ধরছে স্থিতি। গতিতেই তার বিরক্তি। বলছে থামো, ঢেড় হলো, রসো, বসো, পারবেনা এই শৃঙ্খলিত, কবলিত, মধ্য মেধার আক্রান্ত চক্রান্তের অন্দর বাহির মেলাতে। তাই বসে পড়ো। চেয়ে দেখো, তোমার নিজের হাতে প্রায় ষোলো হাজার টাকায় কেনা ইজিচেয়ার তোমাকে স্বাগত বলছে। আরামদায়ক কেদারায় ঘুমাও সারা রাত।
বিপ্লব, বিরোধ, প্রতিকার, স্বাধীকার, পরিবর্তন, প্রতিবিধান, প্রতিদান, সহমর্মিতা, ইত্যাদি একশো শব্দের মৃত অস্তিত্বের উপর মাছি ভনভনিয়ে উড়ছে। এমনই দেখি। ওই শপিং মল থেকে মানুষ বেরিয়ে আসছে। কিলবিলিয়ে উল্লাসে আহ্লাদে আটখানা।
একটা আমেরিকান জীবন যাত্রার যাত্রী আমরা সবাই। উচ্ছ্বাস আবেগ আদরে মাখামাখি যাপন মারিয়ে চলেছে অমৃতস্য পুত্রার অস্তিত্ব। দেখি বাংলা নাটকের বাজার ব্যবস্থার কাটাকাটি মারামারি, আর বাহাদুরি। কেমন হাস্যকর লাগে। স্বশংসাপত্র দিয়ে আত্মপুলকিত এক আত্মরতি মগ্ন সুখানুভব, যা আদৌ কষ্ট কল্পিত অপরাধের পর প্রথম কারাগারের রাত্রি বাস যেন। এখন সব অনুমোদনই ইচ্ছা সুলভ। সবার ছাড় সবাই নিজেই আবিস্কার করে নিয়েছে। দাতা কেউ নেই। শুধু রাশিরাশি গ্রহিতায় ঠেশাঠেশি ভীড়।
‘‘আমি সব সময় দেখি বিজন ভট্টাচার্য আমার বিছানায় বসে হাসছেন। নিজের সেই চিৎকৃত ভঙ্গিমায় হাঁটুতে চাপর মেরে কেবলই বকবক করছেন।’’
না না। থাক… এ পর্যন্তই থাক। কি লাভ হবে অনর্থক এই ভাব বাক্যে কথা বলে?
হ্যাঁ, একটা কথা। আগে ভাগেই বলে রাখি। বর্তমানে আমি উন্মাদ। একেবারে অবসাদে আচ্ছন্ন আমার হৃদয়।
নেগেটিভ না পজেটিভ কথা তা তো বিপন্ম বোধের উপর ভিত্তি করেই জাগরিত অবস্থায় সম্প্রসারিত হয়। করলে, সচেতন সকলের রাত্রি জাগরণের প্রাথমিক উপলব্ধিতে এলে, উদ্ভিন্নযৌবন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পেতেই পারে।
কারণ, আমি সব সময় দেখি বিজন ভট্টাচার্য আমার বিছানায় বসে হাসছেন। নিজের সেই চিৎকৃত ভঙ্গিমায় হাঁটুতে চাপর মেরে কেবলই বকবক করছেন।
“……তোমার আমার বিভ্রান্তি হতে পারে, কিন্তু মিছিলের কোন বিভ্রান্তি থাকতে পারে না। কেননা অনন্ত চৈতন্যের স্বাগ্নিক সহস্র নায়ক এই মহা মিছিলের পথ নির্দেশ করে চলেছে। আমারই মিছিল ঠিকই। কিন্তু মিছিলেরই একান্ত আমি, বা আমিই মিছিল। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ক্ষুরধার যুক্তিবাদ— এই আপাত বৈপরীত্যের সমাধান করবেই করবে।”
একটু পড়েই রেগেমেগে এক সার। সে এক বিভৎস দশা…. “কমিউনিস্ট পার্টি আমাকে নাট্যকার করেছে, ব্রিটিশের চক্রান্ত, দেশীয় মানুষের লোভ লালসা, যুদ্ধের কারণে খাদ্যাভাব ইত্যাদির মাঝে সাধারণ মানুষের কোণঠাসা বাস্তবতা নিয়েই নবান্ন হয়ে উঠেছিল। যা ছিল মানুষের নিজের প্রতিবিম্বে বিম্বিত আত্মদর্শন।
শিল্পের জন্য শিল্প রবে অনুগত, এই দর্শন পাল্টে পেশাদারি রঙ্গালয়ের বিলাসী বিলাপ থেকে সরে এসে নতুন ধারণার জন্ম হয়েছিল। কি তা বলো তো? কচুরিপানায় দল হয়ে নাটকের খিদমত খাটছো বেকার বেকার। বোঝ না শিল্প হবে মানুষের জন্য?”
আমি তখন হ্যাঁ, না মানে করি, কিছু তেমন বলতেও পারি না। আর তাতেই পড়ে কাঁধের উপর চাপড় —- “রাজনীতি বিবর্জিত শিল্পকর্মের কথা, কী সঙ্গীতে, কী নাট্য চিন্তায় ভাবা যায় না। যায়? এই ভাবনায় গণনাট্যের পারম্পর্য পরিপ্রেক্ষিত স্বীকার করতেই হবে।
‘‘প্রশ্ন তুলে চেঁচিয়ে বলি নি আমি, কেন রমরমা গণনাট্যের পারম্পর্য বাংলার উন্মুক্ত মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হলো না বিজনদা’’
না না। পারিনি বলতে।
কিছুতেই বলতেই পারলাম না ৩৪ বছরের বাম রাজত্বে গণনাট্য ব্যতিরেকে কেন তবে এই ভুঁইফোড় গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট জন্ম নিল। কেন গ্রুপ থিয়েটার বাজার মাতিয়ে দশকে দশকে দশমিক থেকে ভগ্নাংশ হয়ে কেবলই সরল অঙ্কের যোগ বিয়োগ গুন ভাগ নিয়েই মগ্ন হলো। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড ব্রাকেটে সমষ্টিকে নিয়ে প্রথম আলো দিতে পারলো না।
প্রশ্ন তুলে চেঁচিয়ে বলি নি আমি, কেন রমরমা গণনাট্যের পারম্পর্য বাংলার উন্মুক্ত মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হলো না বিজনদা।
এই দায় ভার ২০২৩ সালে তবে কার?
বলবো কি করে, তখন তো চলছে তারস্বরে চিৎকার “commitment ছাড়া তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। you must be committed. you must be committed to the people, you must be committed to their cause. without being committed you can not act, you should not breathe……. “
এতো বড় মানুষের ছায়ার তলায় ক্রমেই আমার কায়া ম্লান হতে থাকে। আমি তলিয়ে যেতে গিয়ে ভেসে থাকি, আর শুনি—-
উনি বলতে শুরু করলে থামতে বা শুনতে বাধ্য থাকেন না।
….. সবাই থিয়েটারে আসে কেন? বোঝ না? পরিস্কার কথা
১) নাম কামাতে,
২) একটা উৎপাদিত প্রোডাক্ট হতে,
৩) সিনেমা সিরিয়ালে, ওয়েভ সিরিজে নেমে বিখ্যাত হতে,
৪) কিছু পয়সা গাড়ি ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে স্যুটেড বুটেড লাইফ স্ট্যাইল পেতে।
দরকার হলে রাজ্য রাষ্ট্র রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বাজার ব্যবস্থায় নিজের অস্তিত্ব ধরে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে। অর্থনীতি গত ভাবে শিল্পী তিন রকম। সৌখিন, পেশাদার ও ব্যবসায়ী। সৌখীনেরা চেষ্টা করেন, যতদিন পারেন কাজ করেন। প্রতিশ্রুতি দেন তারপর সংসারী হন।
‘‘সোস্যাল মিডিয়ার সেলিব্রিটি হওয়া এক বিশেষ সমাদরের জীবন। হবে না কেন, থিয়েটার মধ্যবিত্তের হাতের খেলনা।’’
আমাদের গ্রুপ থিয়েটারগুলো এইসব শিল্পীদের দ্বারা গঠিত, পরিচালিত, এবং সসঞ্জীবিত ছিল। বর্তমানে গ্রুপ থিয়েটার পেশাদার হতেই মরিয়া লড়াই লড়ছে। ভাইয়ের সাথে, ভাইয়ের বিরুদ্ধে অন্ন কাড়াকাড়ি করার ডাস্টবিনের দুর্দশা চলছে। বেড়েই চলেছে সংখ্যা, কারণ অবসাদ বিসন্ন জীবন বিপন্নতা থেকে মাথা তুলতে চাইছে। রাষ্ট্র রাজ্য, সব সরকারই হাত তুলে হরিবোল বলছে।
চাকরি নেই কোথাও। টোট অটোরিকশা ব্যাপক আছে তাই শিক্ষিত বেকারদের পেটের ব্যবস্থা হচ্ছে। বেশ কিছু থিয়েটার রাষ্ট্রের টাকায় কেনা গোলাম। তারা বিলাসিতা করছে নাটকের জগতে। শিল্পীকে ভাতা দিয়ে মাল বওয়াচ্ছে। কেবলমাত্র ইচ্ছা পূরণের জন্যে। ইচ্ছা মতো নায়ক হলো দলের নাট্য প্রধান স্বয়ং। লাভজনক ব্যবসা, এবং বাড়তি সম্মানটুকুই পেলেই এদের চাওয়া শেষ হয় না।
সোস্যাল মিডিয়ার সেলিব্রিটি হওয়া এক বিশেষ সমাদরের জীবন। হবে না কেন, থিয়েটার মধ্যবিত্তের হাতের খেলনা। ভাঙে আর গড়ে। কচুরিপানার দল হয়ে একই নাটকের বাজারে এদিক ওদিকে ইতিউতি উঁকি মেরে অনেক তরুণদের গলায় পা চেপে নিজেই থিয়েটারের ফ্যাসিস্ট সম্রাট বনে নিজেকে হিটলার বলে ভাবে।
মনোরঞ্জন, বিনোদনের জন্য বর্ষা ময়ুরের পেখম তুলে নাচাই এই থোর বড়ি খাড়ার ঝাল চচ্চড়ি। তাতে আছে ধনেপাতার গন্ধে বিপ্লবের ঝলক কিছু। বাকিটা রসুন পেঁয়াজ এর ঝাঁজ, নাটকের পরীক্ষা নিরিক্ষার নিরাপদ নিরাপত্তার রাষ্ট্রীয় তোষণ তোষামোদ। পৃথিবী যতই অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এই থিয়েটারে ততই বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।…আরো বাড়বে, যাও ঘুমাও… চলে গেলেন বিজন ভট্টাচার্য জানলার গ্রিল ভেদ করে। আমি হা হয়ে আরও ম্রিয়মাণ এক জাহাজ ডুবির নাবিক হয়ে আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকলাম।
হ্যাঁ, এই রকমই মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। আপনি অনেক বড় চিল নজরে দেখছেন, এই সময়কে। প্লিজ আপনারা চলুন। এগিয়ে চলুন। গিয়ে দেখুন সূর্য কোথায়। পেলে সূর্যকে হাতের মুঠোয় এনে এই জিজ্ঞাসা গুলি করুন।
স্টার কনসেপ্ট দিয়ে এই পেশাদার থিয়েটার কোন সুদিন এনেছে। জানুন সব, শুধু আমাকে দয়া করুন। আমি থামি। আমাকে একটু বসতে সূযোগ দিন আমাকে নাটকের প্রসঙ্গে আর কিছু লিখতে বলবেন না। কারণ আমি আর কার্যক্ষম নই। অবান্তর লাগে নিজেকে।
কেন এ কথা বলছি?
মানে, এটা মনে হয়, একান্তই নিজের অনুভব। বিষয় হলো ওই…. এক এক সময় চোখে কোন কিছুই ঠিকঠাক ঠাহর করে উঠতে পারছি না। নিজেরই কেমন অন্ধ লাগছে। মনে হছে চোখের নজর কমে যাচ্ছে। ভাল দেখতে পাচ্ছি না। কোন কিছুই পরিস্কার নয়। অস্বচ্ছ অস্পষ্ট। সব কিছুতেই সন্দেহ। অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে। নাটকের ভূবণে সবার চলার উদ্দেশ্য বিধেয় পরিস্কার কি না, এইসব আর কি।
মানে দুইয়ে দুইয়ে চার কিভাবে বুঝিনা, নিজের অক্ষমতায় তাই সন্দেহজনক লাগছে। আবার কখনো ছলে বলে মায়া মোহ দিয়ে নাটকের মহম্মদ বাদশাহ হবার একটি মাত্র পঞ্চাশ বছরেরই একটি জীবন আহা। নিজেকে তলিয়ে ফেলার ডুব সাঁতার চমৎকার চলছে। সব কেমন যেন অবিশ্বাস্য।
হয়তো উৎপল বিজন শম্ভু অজিতেশ ভুত আমাকে খুব বেশি জড়িয়ে ধরে আছে। তাই নাটকের বন্ধু কেউ কাছে এলেই ভাবছি উনি কি আমার কাছের বিশিষ্ট বন্ধুজন? নাকি ছদ্মবেশে শত্রু কেউ? নাহলে আজ হঠাৎ ঘনিষ্ঠ হবার পেছনে তার আসল উদ্দেশ্য কি?
আমাকে স্মরণ করার কারণ-অভিসন্ধিতে আছে কি কোন বদ মতলব? চারপাশ বিচ্ছিরি রকমের অন্ধকার। ভাবছি, এখন কি সকাল? না রাত? সারা বছরই নাটকের নানা কাজে সারা পশ্চিম বঙ্গে অনেক মঞ্চে চষে বেড়াচ্ছি।
কিন্তু পানসে আলুনি চর্বিতচর্বন, উঃ, মাথার ভিতরে কি একটা বন্ বন্ ক’রে ঘুরছে।
‘‘কি পাবো আর? কি দেবে এই আত্ম সর্বস্য নাট্যালোক? তাহলে এতদিন আমি কি খুঁজে চলেছি? যা সব দেখছি তা কি সব ঠিকঠাক, মানে বাস্তবানুগ?’’
বলার কথা কি তা গুলিয়ে ফেলেছি। ভাবছি ১৯৭৫ সালে সেই মারীচ সংবাদ নাটকে লালবাগ শহরের একটি ছোট্ট ঘরে যে নাটকের পাঠে মন দিয়েছিলাম, যেখানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোই ছিল প্রকৃয়া প্রকৃতি। তারপর ফরাক্কায় সেই ১৯৮৫ সালে অমল রায়ের মৃত্যু নেই নাটকের উদ্দীপনায় কি লাভ লভেছি, ভাবছি সব। সবাই সবার মতো ফিরে গেল সংসারে, আমি কেন ছুটছি আজো।
কি পাবো আর? কি দেবে এই আত্ম সর্বস্য নাট্যালোক? তাহলে এতদিন আমি কি খুঁজে চলেছি? যা সব দেখছি তা কি সব ঠিকঠাক, মানে বাস্তবানুগ? উদ্দেশ্য বিধেয় নিয়ে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের মতো প্রকৃতি প্রকৃতই প্রচ্ছন্ন? নাকি একটা গোলাম গোলমাল চলছে কোথাও? এ কোন সময়ে এসে পৌঁছেছি, তাই ভাবছি। না কি সবই ঠিকঠাক আছে, সবই আমার অতি ভাবনার কুফল?
কিন্তু আমি তো কোথাও তিষ্ঠতে পারছি না। বয়স বেশ বেড়েছে। রোগের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়তে হবেই। বসে পড়লেই অচল হয়ে যাব সে ভয়। মোবাইলে একটা মেসেজ এলেই খুলতে ভয় করে। এক্ষুনি কি ব্যাঙ্কের সব টাকা হ্যাকার কেড়ে নেবে নাকি? উনি বিপদে পড়ে টাকার সাহায্য চান
ধার দেবো কিন্তু ফেরত পাবো তো? খবরের কাগজ খুলতেই ভয়। দিকে দিকে টাকার লুটপাট। স্ক্যাম আর স্ক্যাম। এক ছেলে বৃদ্ধ এক অসহায় মাকে ছেড়ে গেছে ষ্টেশনের প্লাটফর্মে। কোন এক স্বামীর সাথে প্রতারণা করে অন্য পুরুষ নিয়ে বিছানায় আছে তার স্ত্রী। দুরন্ত দুর্বার কামনার কামাল আনন্দে মাতোয়ারা দু’জনই।
আজ রাতে আর ঘুমাবো না। আজ ২৪শে মার্চ। সুন্দর রাত। ছাদে চলে এসেছি। না রাতের খাবার টেবিলে ঢাকাই আছে। একটা প্লাস্টিকের হাতলওয়াল চেয়ারে আকাশ মুখো হয়ে বসলাম।
দুদিন পরেই বিশ্ব নাট্য দিবস। এটা কি দেওয়ালী না হোলিউৎসব উৎসব। নাকি বেঁচে থাকার অঙ্গিকার নেবার, নাটকে জীবন খুঁজে চলবার দিন? জীবন। হায় জীবন। “মা মুঝে টেগোর বানা দে” বলা। শুধু ইচ্ছাপোষণ করে ইচ্ছেমতো পার্বণের সারারাত হ্রদের কিনারা ঘেঁষে বসে প্রেমিকার নরম হাতে হাত রাখা, ভালবাসি বলা নাকি
ঝলসে উঠলো এক তারা!
কি ওটা!
ওমা উৎপল দত্ত, দত্ত পুকুরের আকাশে জ্বাজ্জল্যমান নাকি! “আমাদের অভিজ্ঞতা—গত একশো বছর ধরে বাংলায় রাজনৈতিক নাটক, রাজনৈতিক নাট্যশালা কার্যকরীভাবে উপস্থিত রয়েছে। তার অস্তিত্ব রয়েছে। এবং শুধু তাই নয়, বিদেশেও যে কোন দেশের নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের যদি তুলনা করি, আমাদের নাটকে দর্শকের অংশগ্রহণ ঢের বেশি। তাঁরা ঢের বছর শি উত্তেজিত হন। তাঁরা ঢের বেশি ইনভল্ভড হন নাটকে।….”
মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম। সেই বাক্যগুচ্ছ পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো? কিন্তু চারিদিকে এক পজিটিভ নাট্য প্রত্যাশায় হতাশার তো কোন স্থান নেই। তবে মাথার রোগ বেড়েছে নাকি!
…..”এখানকার যে মানুষ মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে ভোট দিয়ে জেতায়, সেই আবার বাবা তারকনাথ ছবি দেখতে ভীড় করে,….ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার বিশেষ কোন দ্বন্দ্ব নেই। এ কথা সত্যি নয় যে, বিপ্লব করবার আগে প্রত্যেক মানুষকে নিরীশ্বরবাদী হতেই হবে।
কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে যখন বলশেভিকরা লড়াই শুরু করেছিলেন, তখন তার শ্রমিকরা প্রত্যেকে আগে নিরীশ্বরবাদী হয়ে তার পরে অক্টোবর বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিল এমনটা সত্যি নয়। চেয়ারম্যান মাও-ৎসে তুঙের নেতৃত্বে যখন চীনের মুক্তিফৌজ এগোতে শুরু করে, সে মুক্তিফৌজের প্রত্যেক সৈনিককে আগে নিরীশ্বরবাদী হতে হয়েছে, এ কথা ঠিক নয়।
আসল কথা রাজনৈতিক থিয়েটার হয়নি ব’লে যে হতাশা চালু করার চেষ্টা চলছে সেটাও এইরকম ভাবেই ঠিক নয়। বরং এটা হয়তো বলা যেতে পারে যে আমরা এখনো বিপ্লবী থিয়েটারের পর্যায়ে উন্নীত হতেই পার নেই।….. থিসিস আ্যন্ড আ্যান্টি থিসিস এটা না বুঝতে পারলে আমরা সমাজের কন্ট্রাডিকশনগুলোকে, আমাদের দ্বন্দ্বগুলোকে সঠিকভাবে দর্শকের সামনে উপস্থিত করতে পারছি না।
সেটাই হচ্ছে বিপ্লবী থিয়েটারের প্রধান কাজ। মানুষকে নিয়েই এই পৃথিবী দ্বন্দ্বে ভরা। এই আমাদের জীবন। আমাদের সমাজ। সবকিছুই দ্বন্দ্বে ভরা, এটা সেই ডায়েলিক্টাল চেতনা যা মানুষকে দেওয়ার ছিল। হয়তো আমরা বিশেষভাবে এই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়েছি।…”
‘‘আমি জানি পদদলিত শোষিত পিছিয়ে থাকা মানুষের সংগ্রামে উৎপল দত্ত নিজেকে সামিল করতে চেয়েছিলেন’’
আমি জানি পদদলিত শোষিত পিছিয়ে থাকা মানুষের সংগ্রামে উৎপল দত্ত নিজেকে সামিল করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর যাবতীয় নাট্য রচনার মূল বিষয় হয়েছে সংগ্রামী মানুষের কাহিনী। তাঁর বিদ্রোহী নাট্যসত্তা কলম ধরেছে রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র, ধর্মীয় মৌলবাদ পুষ্ট সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ কুসংস্কার ও শক্তিমানদের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে।
তাই দেশ-বিদেশের যাবতীয় ইতিহাস তিনি খুঁটিয়ে পড়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন নাটক হাতিয়ার হোক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করতে। যে ব্যবস্থায় আসতে পারে মার্ক্সবাদী চেতনার গনজাগরণের পালা।
এ সবই সবাই জানেন। কিন্তু একটা মাত্র শেষ কথা বলার মালিক এখন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, সারা বিশ্বের কৃষ্টি ও কৃষি খামারের প্রভুত্ব করা কালো হাতের থাবার তলে লোভী থিয়েটার দুনিয়া বোকা ভিখিরি হয়ে বাংলা নাটকের চলতি বাজারের পুঁজিভিত্তিক অবস্থায় টাল খেয়ে উল্টে পড়ছে। কিন্তু গড্ডালিকা প্রবাহের দিকে স্রোতের অভিমুখে ছুটে চলেছে। কিন্তু বিরুদ্ধে যাচ্ছে না। অস্তিত্বের জন্য ভয়ে ভীত সবাই।
যদি তার নাটকের ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে যায়? তবে এই বাংলার বনভূমিতে কোন আবাদ ফলবে? ভাবতে বসলেই কত কথা উড়ে আসে। শম্ভু, অজিতেশ, ঋত্বিক, বিজন, উৎপল সকলের কত স্বপ্ন ছিল। কিন্তু কি আর এমন বলার মতো পাওয়া পেলাম। কিন্তু আশা? সে তো আছেই, জাগরূক মহিমায়।
একটা বাংলা নাটকের দরবার দশকে দশকে বারবার মত আর মতানৈক্য অনুসারে খন্ডে খন্ডে ভেঙেই গেছে। ভাঙ্গুক কিন্তু পথ দেখাতে হবেই। মফস্বলি হাজারো ছেলেমেয়েরা শক্তি দিচ্ছে। বাজার থেকে বেরিয়ে মুক্তির পথে কে দেবে আলো, সেই নিশানার খোঁজে আছি। সবভাবেই কলকাতার নাট্যচর্চা চিরদিন মফস্বলকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু নিশ্চিন্তভাবে, শান্তিতে, সার্থকতায় নাটক সহ খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জীবন দিতে পারে নি। বিভিন্ন বিভ্রান্তিতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছে।
নাট্যব্যক্তি এখানে দলের শক্তির মূল আভা। তার চালনা নাট্য পার্বণের উৎসকথা।
কিন্তু জীবন বড়ো ছোট কাজের জন্য। মাত্র পঞ্চাশ বছরের সক্ষম জীবন নিয়ে কত কি-ই বা করতে পারে। যদি কোন এক কৃতি পরের উত্তরসূরী তৈরি করতে পারে? কই পারছে না তো। সবাই পথের এ মোড় ও মোড়ে ঘুরেফিরে একই বৃত্তে ভেসে যাচ্ছে। শক্তির কি অপচয় নাকি এই পথেই শক্ত চোয়াল জন্ম নেবে? এই সম্ভাবনা বা দুঃখ ব্যথা নিয়েই এবারের বিশ্ব নাট্য দিবস আসছে। কিছু কি নতুন ভাবে শুরু হতে পারে? কি জানি, ভেবেই চলি রাতভর।
অপেক্ষা করি। ভোর হোক। চিন্তা চলুক। মানুষ চেতনা হারায় নি, এটাই আশার বিষয়। এক আশ্রয়। নেগেটিভ কিছুই ভাববো না। সবই সম্ভব। পারি, পারবো, পারতেই হবে,…কিন্তু সতীর্থ মানুষ একটু সদয়তার সাথে পাশে থাকুক। বিজন ঋত্বিক উৎপল অজিতেশ বাদল শম্ভু মানস, আমাদেরকে আক্রান্ত করুক। আমরা পথ চিনে চলতে ঠিকই পারবো।