পার্থ সারথি গোস্বামী
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়োজনে গত ৩মে দিল্লির মুক্তোধারায় বাংলা নাট্যমেলায় যাপনচিত্রের প্রযোজনা ‘পাপ’ মঞ্চস্থ হল। সমরেশ বসুর ‘পাপ-পুন্য’ গল্প অবলম্বনে, চট্টগ্রামের বিদগ্ধ নাট্যকর্মী ‘অ্যাভাঁগার্ড’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালক সুমন টিঙ্কুর নাটক ‘পাপ’। সুহান বসুর নির্দেশনায় এক ঘন্টার টানটান উত্তেজনাময় নাটকে ডুবে রইল দিল্লির নাট্যপ্রেমী দর্শক।
নাট্যকার এবং নির্দেশকের মতে, “বাংলা সাহিত্যের তেজস্বী এবং সর্বতোভাবে সাহসী এক সংশপ্তকের নাম সমরেশ বসু, যিনি তাঁর কলমকে সত্য কথক বানিয়ে তরবারির মত ছুটিয়েছেন, যা সভ্যতার যত অসুন্দর, মিথ্যে অহমিকা, পলকা কাচের গৌরবকে নিরদ্ধিধায় ভেঙে খান খান করে দিয়েছে। সভ্যতার কুটিল চরিত্ররা সত্য বলার অপরাধে, ভ্রান্ত অহংকে ধ্বসে দেয়ার আক্রোশে তাঁকে বারবার আঘাত করেছে, কিন্ত তিনি এতটুকু মুষড়ে না পড়ে তাঁর যুদ্ধে অটল থেকেছেন।
মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষই, দেবতা নয়। তাই, তার ভুল হয়, সেই ভুলের শোধন হয়, পাপ হয় এবং তার প্রায়শ্চিত্তও হয়। সেইসব ভুল এবং পাপচক্রের নির্মোহ কথন ‘পাপ-পূণ্য’।
আকস্মিক আত্মহননের পর পার্বতীর শবদেহ নিয়ে মহাশ্মশানের পথে তার বিধ্বস্ত পিতা কালু এবং প্রেমিক বলরাম। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা দুজনেই মুহ্যমান এবং দিগভ্রান্ত। আত্মবিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করে পার্বতীর আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণসমূহ, বিদায়ের শেষ মুহূর্তে তার মানসিক দ্বন্দ্ব। এক অজানা বিবেক দংশনে দুজনেই এই আত্মহত্যার জন্য নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করেতে থাকে। আত্মহননের মত জঘন্য পাপের দায় যে শুধু আত্মহত্যাকারীর একার হয় না, সে দায়ের ভাগ থাকে পরিবার, পরিজন, পরিস্থিতির। কিন্তু আত্মবিনাশই কি একমাত্র পাপ, নাকি আরও বড় কোন পাপ লুকিয়ে আছে এই ঘটনার পেছনে? তবে সেই পাপের শাস্তি পার্বতী কেন একা ভোগ করবে? আকস্মিক এক ভুল, পার্বতীকে এমন ভাবে জীবন থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু কি সেই ভুল? কি সেই ‘পাপ’? গল্পের গতিপথে সেই দ্বন্দ্বই ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়, দর্শকের উৎসুক, পিপাসু মনে, উত্তরের শ্রাবণ ধারা নেমে আসে।
সমরেশ বসুর ‘পাপ-পূণ্য’ গল্পটি একটি সরল রেখায় এগিয়েছে, কিন্ত তাকে নাটকে রূপ দিতে গিয়ে নাটকীয়তার আবশ্যিকতার কারণে তাঁর লিখিত গল্পের মত করে এই নাটকের কাহিনীকে সরলরেখায় চালিত করা যায়নি। দ্বন্দ্ব, সাসপেন্সএসব অনুসঙ্গকে নাটকে প্রাধান্য দিতে হয়; ফলে, গল্পকে কিছুটা বক্রপথে চালিত করতে হয়। তাই, ‘পাপ’ নাটক যদিও উপরোল্লিখিত গল্পের প্রেরণা, কিন্তু এটিকে নাটকের পথে নিয়ে আসতে গিয়ে কিছু অতিরিক্ত ঘটনা, চরিত্রের নাম পরিবর্তন এবং প্রয়োজনীয় চরিত্রের অনুপ্রবেশ ঘটাতে হয়েছে, যা এই নাটকের নাটকীয়তাকে জোরালো করেছে। স্বভাবতই, নাটকের ঘটনা হুবহু লিখিত গল্পটির মত না থেকে সে তার আপন গতিপথ ধরে এগিয়েছে”।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অংশ নিলেন, সুহান বসু, সুমন কুন্ডু, নবনীতা চ্যাটার্জী, অর্ণব বসু, বিশ্বজিৎ ঘোষ, সুকুমার সর্দার এবং সুবর্ণ ঘোষ। আলো বিন্যাস এবং প্রয়োগ রঞ্জন বসু, আবহ নির্মাণ এবং প্রক্ষেপণ সৌরশান্ত বিশ্বাস, মাল্টিমেডিয়া সানন্দিতা চ্যাটার্জী।
যেমন নির্দেশনা তেমনই প্রত্যেকের অভিনয় প্রতিটা দর্শককে নাড়া দিয়ে গেছে বিশেষত, কালুর চরিত্রে সুহান বসু এবং বলরামের চরিত্রে সুমন কুণ্ডু বিশেষ প্রশংসা রাখে। শেষ দৃশ্যে কালুর পাপ স্বীকার প্রায় প্রত্যেক দর্শককে বাকরুদ্ধ করেছে। যেমন স্ক্রিপ্ট আর তার সাথে তেমন অভিনয়। সঙ্গে শেষ দৃশ্যে মঞ্চ আলো এবং প্রজেক্টরের ব্যবহার কালুর আর্তিকে যেন এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। নাটকটির সেট করেছেন সুদীপ বিশ্বাস।
দিল্লির নাট্য দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই খুব ভালো কাজ করে চলেছে যা প্রবাসে বা ভিন্নরাজ্যে বসে করাটা ভীষণ দুরূহ এবং প্রতিকূলতায় পূর্ণ। দিল্লীতে জীবনযাপনের ব্যায় যেমন অনেক বেশি তেমনই প্রেক্ষাগৃহ, আলো, সেট, প্রোজেক্টর খুবই খরচ সাপেক্ষ তার ওপরে দিল্লীতে টিকিট কেটে বা অনুদানের ভিত্তিতে নাটক দেখার দর্শক খুবই কম। সুহান বসুর কোথায়, যাপন চিত্রই প্রথম নিয়মিত টিকিট কিংবা অনুদান ভিত্তিক নাটক দেখার ব্যবস্থা করে যা আজ অন্যান্য, প্রায় ২০টি দল অনুসরণের চেষ্টা করছে। যদিও টিকিট বা অনুদান মুল্য পশ্চম্বঙ্গের তুলনায় অনেকটাই কম তবুও সুহান বসুর বিশ্বাস দর্শকদের অভ্যাস তৈরী হয়ে গেলে তারা বেশি দাম দিয়েই টিকিট কাটবেন এবং নাটকের গ্রুপের আর্থিক দুর্বলতার কথা বুঝতে পারবেন। তবে সেই সঙ্গে, সুহান বসুর বক্তব্য, দিল্লীর দর্শক অত্যন্ত উচ্চমানের শিল্প সংস্কৃতি প্রেমী এবং তাঁরা ‘ভাল’-র কদর করতে জানেন।