কিশোর কুমারের বিখ্যাত সেই গান – যানা থা জাপান পৌঁছ গয়ে চিন…। ‘জমালয়ে জীবন্ত ভানু’ দেখতে গিয়ে অনেকটা সেই রকমই মনে হতে পারে। ছবির নাম প্রকাশের পরই খানিকটা হলেও আন্দাজ করা গিয়েছিল এ ছবির কাহিনি এগোতে পারে কোন দিকে। তবু, সবকিছু থেকেও যেন ভানুকে খুঁজতে গিয়ে মুশকিলে পড়তে হয় দর্শককে।
অথচ, বাঙালিকে আকর্ষণ করার মতো কী নেই এ ছবিতে। অতীতে ইতিহাস তৈরি করা ছবি ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ এবং কিংবদন্তি অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম অথবা, ওই সময়ের বেশ কিছু জনপ্রিয় ছবির আকর্ষণীয় দৃশ্যের পুনর্নির্মাণ, মনকাড়া সংলাপ, মনে রাখার মতো গান এবং জীবন্ত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। নিটোল হাসির ছবির প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয় ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’।
ছবি শুরুর খানিক পরেই ছন্দে একটু একটু করে শুরু হয় পতন। কোথাও যেন, হাসির ছবির মূল দর্শন থেকে ক্রমশ সরে যেতে থাকে ছবিটি। সব হাসির পিছনেই লুকিয়ে থাকে যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা থেকেই জন্ম নেয় হাস্যরস। কিন্তু, যদি শুরুতেই ভেবে নেওয়া হয় শুধুমাত্র মানুষকে হাসানোর জন্যই অভিনয় বা পরিচালনা, তা হলে একটি নিটোল হাসির ছবি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কমতে থাকে। হাসির গল্পের টানাপড়েনে চরিত্রের যন্ত্রণা ও সঙ্কট যেন যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তোলা গেল না এ ছবিতে।
এই ছবি শুরু হওয়ার আগেই ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ এবং ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’ নাম দু’টি কৌশলে দর্শকের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই দু’টি নাম বাংলা হাসির ছবির জগতে মাইলফলক। স্বাভাবিক ভাবেই দর্শক উজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে বাস্তবকে মেলাতে থাকেন। পরিচালকের লক্ষ্যও সেটাই ছিল বলে মনে হয়। কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট একটি গতিতে ছবিটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হত। কিন্তু মাঝপথেই ছবির চিত্রনাট্য খেই হারিয়ে যেন হাঁপাতে থাকে।
চরিত্রদের অতিরিক্ত সংলাপ এবং বিক্ষিপ্ত চিত্রনাট্য ছবিটিকে ক্রমশ শ্লথ করে দেয়। ক্যামেরাও হঠাৎ কেমন যেন শান্ত হয়ে যায়। ‘কম্পোজিশন’ ছাড়া নির্দিষ্ট ফ্রেমে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘ দৃশ্যের চিত্রায়ণের ফলে দর্শক অস্থির হতে বাধ্য। অযথা বাড়তে থাকে গল্পের জটিলতা। হারিয়ে যেতে থাকে খেই।
তবে পরিচালক চেষ্টা করেছেন দর্শকের মনে ভানুকে ফিরিয়ে আনার। যেমন, ভানু ও সাম্যময়ের ফাইল খোঁজা, শ্মশানে বৃষ্টি আসা বা গাড়ি চালাতে চালাতে ‘আশিতে আসিও না’ ছবির আদলে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়ের গান, ভানুর মুখে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘মাসিমা মালপো খামু’ (এখানে অবশ্য ‘মাসিমা’ ‘পিসিমা’ হয়েছেন স্বত্বাধিকারের কবলে), সবই আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, নেই শুধু ভানু।
পরিচালকের মতোই ভানুরূপী শ্বাশত চট্টোপাধ্যায় পর্দায় আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ভানু হওয়ার। চিত্রগুপ্তের ভূমিকায় শুভাশিস মুখোপাধ্যায় এবং বিধাতার ভূমিকায় পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলার মতো কিছু নেই। সব মিলিয়ে ভানুকে আরও একবার রূপোলি পর্দায় বাঙালি দর্শক খুঁজতে গিয়ে মনে করতেই পারেন, যমালয়েই গিয়েই একমাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা হতে পারে। আজকের বাংলা সিনেমায় নয়।