Tuesday, December 3, 2024
Tuesday, December 3, 2024
HomeনাটকএকালThe State and the Theatre: কর্পোরেট পুঁজি, রাষ্ট্র ও থিয়েটার

The State and the Theatre: কর্পোরেট পুঁজি, রাষ্ট্র ও থিয়েটার

সুব্রত কাঞ্জিলাল

পরপর কয়েকটা সেমিনারে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। প্রতিটি সেমিনারে কথা বলার বিষয় ছিল রাষ্ট্র ও থিয়েটারের (The State and the Theatre) সম্পর্ক নিয়ে।

এক দশকের বেশি সময় ধরে এই ধরনের বিষয় ভিত্তিক আলোচনা বন্ধ রাখা হয়েছিল কিম্বা সামনে আনা হচ্ছিল না। এই সময়ের মধ্যে থিয়েটারের মঞ্চে নতুন প্রজন্মের থিয়েটার কর্মীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের কাজ দেখে বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে, এরাও এই বিষয়ে মাথা ঘামাতে চান না। সম্ভবত অন্যতম কারণ, রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে অনেকেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে ন। এর মধ্যে অন্যায় কিছু দেখি না। তবে জনগণের টাকা, আমাদের ট্যাক্সের টাকা কেন গ্রহণ করব না, এসব ভাবার পরেও কিছু কথা এবং বিষয় থেকে থাকে। যা খুবই প্রাসঙ্গিক।

মানুষের কল্যাণকামী রাষ্ট্র মানুষের জন্য খাদ্য বস্ত্র চিকিৎসা শিক্ষা বাসস্থান এই পাঁচটি মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি রক্ষা করবেন এটাই কাম্য। সাংস্কৃতির মান উন্নয়নে আধুনিক পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র নানারকম প্রকল্প চালু করেছেন। ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক।

সামন্ততান্ত্রিক  ব্যবস্থায় অনেক শাসক তাদের রাজসভায় নবরত্ন সভার আয়োজন করতেন। তানসেন, বীরবল, কালিদাস, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকার, এইরকম কবি, সংগীতশিল্পী, নাট্যকারদের রাজা-মহারাজারা পৃষ্ঠপোষকতা করতে ন। আমাদের বাংলার ছোট বড় অনেক রাজসভার রঙ্গমঞ্চে একটা সময় থিয়েটারের চলছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, বিনোদিনী দেবী দের আন্তরিক প্রচেষ্টায় থিয়েটারের গণতন্ত্রিকরণ ঘটেছিল। অর্থাৎ রাজসভার অঙ্গন থেকে জনগণের মুক্তাঙ্গনে থিয়েটারের মুক্তি ঘটানো হয়েছিল১৮৭২ সালে বাগবাজারে অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে নীলদর্পণ নাটক অভিনয়ের মাধ্যমে।

সেটা ছিল পরাধীন ভারতবর্ষের অন্ধকার যুগ। একদিকে যেমন স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আন্দোলন চলছে, থিয়েটারের কর্মীদের মধ্যেও সেই আন্দোলনের প্রভাব তীব্র হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছু নাটক লেখা হয়েছিল যা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামকে আরো গভীরভাবে আলোরিত করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার সেইসব নাটকগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ছিল। নাট্যকার এবং নাট্যকর্মীদের জেল বাস করতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের নাটক ও নিষিদ্ধ করা হয়ে ছিল। নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে থিয়েটারের কন্ঠ রোধের সব রকম উদ্যোগ চালানো হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, এই আইন স্বাধীনতার পরেও বেশ কয়েক দশক বলবৎ ছিল। এই আইনের দোহাই দিয়ে স্বাধীন ভারতবর্ষে অসংখ্য নাটক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। খুন হতে হয়েছিল সফদার হাশমিকে। উৎপল দত্তের জেল হয়েছিল। আরো অসংখ্য নাট্যকর্মীদের বহুবার নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের আগমনের পর  ব্রেখট এর  মত অসংখ্য নাট্য ব্যক্তিত্বদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে অসংখ্য নাট্যকারদের বই, কাব্য কবিতা, এক কথায় লাইব্রেরির পর লাইব্রের ী আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়ে ছিল। হিটলার বলতেন, সংস্কৃতির কথা শুনলে তার হাতটা রিভলভার খুঁজতে চায়।

সে সময় কবি লোরকাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে খুন করা হয়েছিল।। ইতালির প্রখ্যাত নন্দন তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক ক্রচেকে জেলে বন্দী করা হয়েছিল।

আমেরিকাতেও ষাটের দশকে মুক্তকণ্ঠের অধিকারী, প্রতিবাদী শিল্পী সাহিত্যিকদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্যাতন সহ্য করতে হয়ে ছিল। চার্লি চ্যাপলিনের মত অনেক শিল্পীকে সে সময় দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

আমরা যদি আরো পিছিয়ে যাই তাহলে দেখা যাবে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে চলে এই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার অপরাধে কোপার্নিকাসকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গ্যালিলিওকে নির্যাতন করা হয়েছিল রাষ্ট্রের নির্দেশে।

ভগৎ সিং এর ফাঁসি, ক্ষুদিরামের ফাঁসি এমন অসংখ্য অপরাধ রাষ্ট্রের দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময়, মত প্রকাশের সমস্ত রকম সংবিধানিক অধিকারকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আজও রাষ্ট্রের মতামতকে অস্বীকার করার জন্য সেই ব্যক্তি এবং সংগঠনগুলোকে রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রের এই চরিত্র নির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কৃতিক পথে অগ্রসর হয়। রাষ্ট্রের এই পথকে সমালোচনা করা, বিরোধ করা র প্রশ্নে রাষ্ট্র সংবেদনশীল থাকতে পারেনা।

এই কারণেই হয়তো ব্রিটি স দার্শনিক, ইতিহাসবিদ কার্লাইল সাহেব ভারত শাসকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ভারত শাসন আর শেক্সপিয়ার চর্চা একইসঙ্গে হতে পারে না।

এবার আমরা থিয়েটারের সত্য নিয়ে যদি কথা বলতে চাই তাহলে দেখা যাবে, জন্ম লগ্ন থেকে থিয়েটার প্রতিষ্ঠান বিরোধী চরিত্র বা ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল।

শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো জলজ্যান্ত প্রমান। মহাকবির প্রত্যেকটি নাটকে উদীয়মান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক একটি বিস্ফোরণ। মহাকবি সে যুগে বসে তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে পেরেছিলেন, তথাকথিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দানবীয় চেহারা কি হতে যাচ্ছে। তার নাটকে তাই আমরা দেখি, সোনা এবং অর্থ ছাড়া বণিক কুল অন্য কিছু বোঝেনা। তাদের কাছে শিল্প সংস্কৃতি তামাশা মাত্র। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যেকোনো ভাষার শ্রেষ্ঠ নাটকগুলো কখনো শুধুমাত্র মনোরঞ্জনের কারণে লেখা হয়নি। প্রায় প্রতিটি নাটকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অমানবিকতা, রুচি বিকৃতি, ভন্ডামি, অধঃপতনের দলি ল চিত্র রচনা করা হয়েছে।

ঠিক এই কারণেই, পুঁজি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রথম দিন থেকে থিয়েটারের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে এসেছে। যেমন ইংল্যান্ডের ধর্মযাজকদের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে শাসকরা প্রচার করতো, নরকের শয়তানরা থিয়েটারের কারবারি। রঙ্গমঞ্চে পতিতাবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। প্রায়শ পৌরসভা গুলো ইংল্যান্ডের থিয়েটার হল গুলোর বিদ্যুতের লাইন কেটে দিত। নানা উপায় ট্যাক্সের বোঝা বাড়িয়ে চলত।

আমাদের বাংলাতেও প্রচলিত ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল, যাত্রা থিয়েটারে ভদ্র বংশের মানুষেরা যুক্ত হতে পারেনা। থিয়েটারের হল গুলো একেকটি লম্পট দের আখড়া। গুন্ডা পাঠিয়ে থিয়েটারের কর্মীদের মারধর করা হতো। উৎপল দত্তের টিনের তরোয়াল নাটকে দেখানো হয়েছে শত বছর পূর্বের বাংলা থিয়েটারের হাল হাকিকত। ওই নাটকের একটি চরিত্র বীর কৃষ্ণ দা। তিনি জমিদার, ইংরেজ সরকারের মুতসুদ্দি। থিয়েটার কোম্পানির মালিক। থিয়েটার দলের নাট্য পরিচালকের সঙ্গে নাটক সংক্রান্ত বিষয়ে সংঘাতের সময় বলছেন,

আমার দশ আঙুলের দশটা হীরে বসানো আংটির যেকোনো একটা দিয়ে তোমাদের নাটক ফটক শিল্প সংস্কৃতি সবকিছু কিনে ফেলতে পারি।

এই সংলাপ থেকে বুঝতে হবে সম্পত্তিবান শ্রেণিগুলো নাটক ও আমাদের শিল্প সাহিত্য বিষয় কোন মনোভাব পোষণ করে। আজকের কর্পোরেট কালচার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে থিয়েটারকে তারা কিভাবে ব্যবহার করতে চায়।

রাষ্ট্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অনুভব এইরকম। তিনি বলছেন আধুনিক রাষ্ট্রের রাজা রানী কে প্রত্যক্ষ দর্শন করা যায় না। যাদের আমরা দেখি তারা হলো পুতুল নাচের পুতুল। এই পুতুলগুলোকে যারা নাচায় তাদেরকে বলা হয় বানিয়া সমাজ। আজকের পরিভাষায় কর্পোরেট দুনিয়া।

শেক্সপীয়ার বলছেন বণিকের কাছে মুনাফা একমাত্র সত্য। মুনাফার জন্য সে বেদ বাইবেল ত্রিপিটক সবকিছু বেচে দিতে পারে। মুনাফার জন্য যাবতীয় পাপ, অন্যায় অপরাধ, যুদ্ধ রক্তপাত ঘটাতে পারে।

পরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধ তারা সংঘটিত করেছিল মুনাফার জন্য। বাজার দখলের জন্য।

সুতরাং রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করে যারা সেই কর্পোরেট দুনিয়া থিয়েটার কে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করবে। বিজ্ঞানের সমস্ত রকম আশীর্বাদ গুলোকে তারা বাণিজ্যের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। যেমন চলচ্চিত্রের অসম্ভব শক্তিশালী ভূমিকা কে ওরা নিকৃষ্ট বাণিজ্যের উপাদান করে ছেড়েছে। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের একটাই ফর্মুলা সেটা হলো সেক্স আর ভায়োলেন্স বিপণন। এ যুগে তাই পথের পাঁচালী সৃষ্টি হয় না। বাইসাইকেল থিপ এর স্রষ্টারা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আজকের পৃথিবীতে অনুপযুক্ত।

বিগত ৫০ বছরে আমাদের এই বাংলায় দুই একজন ব্যতিক্রমীকে বাদ রেখে আর কোন কবির জন্ম দেখলাম না। উৎপল দত্তের পর আর কোন বিশ্বমানের নাট্য ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দের মত আর কোন প্রতিভা ধর কথাশিল্পীকে খুঁজে পেলাম না। কারণ বাংলার জমি আজ অহল্যাভূমি। এখানে সূক্ষ্ম মানবিক শিল্পের চাষাবাদ হয় না। ব্রয়লার মুরগি শিল্প গড়ে উঠেছে। হাইব্রিড শস্য চাই। যা মুনাফার সহায়ক।

সেই কারণে দুই দশক ধরে বাণিজ্যিক থিয়েটারের কনসেপ্ট প্রচার করা হচ্ছে। অর্থাৎ বাজারের শর্ত মেনে আমাদের থিয়েটারের প্যাকেজিং তৈরি করতে হবে। এই প্রোডাকশনের জন্য একজন ফাইন্যান্সর চাই। কর্পোরেট ডিজাইনার চাই। কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট চাই। পাবলিসিটি চাই। পাবলিক কি খাচ্ছে, আমরা তাকে কি খাওয়াতে পারব, যার পরিবর্তে মুনাফা অর্জন করা যাবে। এইসব নিয়ে এখন থিয়েটারের দুনিয়ার একাংশ বেশ চিন্তা মগ্ন। আমি তাদের যদি বলি, হীরক রাজার দেশে সিনেমাটা বেশ পপুলার। ওই ছবিতে রাষ্ট্রের চেহারাটা স্পষ্ট বোঝা যায়। পারবেন ওটা নিয়ে একটা থিয়েটার তৈরি করতে? কিংবা ব্রেসট এর আর তুরো উই নাটকটা  মঞ্চস্থ করতে? যে নাটকে দেখানো হয়েছে কর্পোরেট ফিন্যান্স কিভাবে এবং কেন হিটলারের মতো দানবকে তৈরি করে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস পাওয়া যাবে না ফাইনান্স। কিম্বা রাষ্ট্রীয় বদান্যতায় অনুদানের টাকায় এইসব নাটক মঞ্চায়নের সাহস কেউ দেখাতে পারবেন না।

মনে রাখতে হবে, পথের পাঁচালী, হীরক রাজার দেশে নির্মাণ করার জন্য প্রাইভেট পুঁজি বা কর্পোরেট খুঁজি এগিয়ে আসেনি। এই দুটো ছবি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকুল্লে সৃজিত হয়েছিল।

স্বাধীন ভারতবর্ষে এক ধরনের মিশ্র অর্থনীতি প্রচলিত হয়েছিল। জহরলাল নেহেরু সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ গ্রহণ করেছিলেন। ব্যক্তিগত মালিকানা যেমন ছিল পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বড় বড় শিল্প তৈরি হয়েছিল। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নাট্য স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছিল। রাষ্ট্রের আর্থিক সাহায্যে অসংখ্য ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছিল। শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের  জন্য সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচা করতো। যেমন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নাট্য একাডেমী, বাংলা একাডেমি, লোক নাট্য একাডেমী, চলচ্চিত্র উন্নয়ন কেন্দ্র, নন্দনের নির্মাণ, কলকাতার ছটি থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠা, জেলায় জেলায় রবীন্দ্রভবন তৈরি, প্রায় পঞ্চাশটির মতন আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ এমন অসংখ্য কাজ হয়েছিল।

পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষকদের জন্য যেমন সাবসিডি দেওয়া হয়, ছোট শিল্পের জন্য ভর্তুকি, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা, নাটক সহ শিল্প-সংস্কৃতির অন্যান্য দিকের ওপর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ প্রচলিত। তবে সোভিয়েত রাশিয়া, গণতান্ত্রিক চীন, কিউ বা ইত্যাদি রাষ্ট্রে  যে ভাবে নাটকসহ শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোটি কোটি কোটি টাকা খরচা করা হয় তার তুলনা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেমন সৌভি এ ত রাশিয়া এবং চীনে পিকিং অপেরা, মস্কো আর্ট থিয়েটার ইত্যাদির শিল্পীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে ধরনের আর্থিক সুবিধা লাভ করত সেসব আমরা কল্পনাও করতে পারব না।

৯ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এক মেরু র বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে রাষ্ট্রীয় পুঁজিকে

তুলে দেওয়া হচ্ছে। পরিবর্তে কর্পোরেট পুঁজি স্থান দখল করছে। এই ব্যবস্থা অর্থাৎ বাজার অর্থনীতিতে চূড়ান্ত অসাম্যের বাতাবরণ গড়ে উঠেছে। এখানে কর্পোরেট সংস্কৃতি এক ধরনের অপসংস্কৃতির চাষাবাদ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া চলছে। রুশ দেশের প্রখ্যাত মনীষী তলস্তয় যে আশঙ্কা করেছিলেন অর্থাৎ জুতোর কারখানা , মদের কারখানা আর নাটক সিনেমা মনন শীল সুক্ষ সংস্কৃতি একাকার করে তোলা হচ্ছে। অনবরত প্রচার চলছে, মনোরঞ্জন ছাড়া শিক্ষা সংস্কৃতির আর কোন লক্ষ্য থাকতে পারে না। বিগত দেড় দশক ধরে আমাদের রাজ্যে কোম্পানি থিয়েটারের নামে যে কনসেপ্ট চালু করা হচ্ছে তারা প্রশ্ন তুলছে, থিয়েটার বা নাটকের কোনোরকম সামাজিক দিশা থাকতে পারে না। অনেকটা হলিউড  বলিউডের মারদাঙ্গা যৌন আবেদনমূলক সিনেমার মতো মুনাফা সর্বস্ব করতে হবে। যে সিনেমা, থিয়েটার, গান-বাজনা, কথাশিল্পের বাজার দর নেই, বিপণনযোগ্য নয় তাকে সরে যেতে হবে। এটাই হচ্ছে বাজার অর্থনীতির শর্ত।

কিন্তু থিয়েটার তর্ক করে। বিতর্কের ঝড় তোলে। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির বিভিন্ন শাখার বিভিন্ন প্রবক্তারা যখন প্রমাণ করতে চায়, তাদের সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক। সেই সময় থিয়েটার সেইসব সিদ্ধান্তগুলো কে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে চায় না। এই জন্যই উৎপল দত্তের কল্লোল নাটকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র খরগো হস্ত হয়। উৎপল দত্তকে জেলে পাঠায়। ৫০ বছর আগে মানিক সংবাদ নাটকের মঞ্চে গুন্ডা পাঠায়।

সুতরাং সরকারের বদান্যতা অনুপ্রেরণায় যখন কোন দল তাদের থিয়েটার প্রশ্ন তোলে, বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করে তখন কি সরকারের পেছনে থাকা প্রকৃত শাসক অর্থাৎ কর্পোরেট পুঁজি সেই থিয়েটার কে অনুমোদন দেবে? কিংবা কজন নাট্য ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যারা মেরুদন্ড সোজা করে থাকতে পারেন? ছলনার আশ্রয় নিতে হয়। কু যুক্তির অবতারণা করতে হয় তখন।

অন্ধকারের সিঁড়িতে পা রাখতে হয়। এইসব দেখেশুনে সত্যজিৎ রায় তার ছবির নায়ক কে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন, আমরা যত ওপরে উঠি, আসলে ঠিক ততটাই নিচের দিকে নেমে যাই।

শঙ্করের উপন্যাস সীমাবদ্ধ চিত্রায়িত করবার সময় সত্যজিৎ রায় এইরকম সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন। গল্পের নায়ক চাকরির প্রমোশনের জন্য কি ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন।

এইসব কারণেই তো মোমবাতিওয়ালাদের মিছিল অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাদের বিবেক চাপা পড়ে গেছে কর্পোরেট পুঁজির পাথরের নিচে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular