বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ১৯
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির ইন্দিরা গান্ধী কলোনীর মেয়ে মৌসমী মন প্রাণ দিয়ে থিয়েটার করে চলেছে। অতি সাধারণ মুসলিম পরিবারের হিন্দিভাষী মেয়েটি লেখাপড়ার পাশাপাশি থিয়েটারকেও জীবনের সঙ্গী করে নিয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে মৌসমী জানিয়েছে, হিন্দিভাষী হয়েও স্কুল জীবন থেকেই থিয়েটার তার মনের খোরাক জোগায়। জলপাইগুড়ি মাড়োয়ারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। তারপর থেকেই সে থিয়েটারে যুক্ত হয়েছে। জলপাইগুড়িতে সৃষ্টি মাইম থিয়েটার দীর্ঘ সময় ধরে মূকাভিনয় নিয়ে কাজ করে চলেছে। সেই দলের কর্ণধার সব্যসাচী দত্তর হাত ধরে তার থিয়েটার চর্চা প্রসারিত হয়েছে। অবশ্য মূকাভিনয়কেই সে তার থিয়েটারের মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছে।
কলা উৎসবের নাটক প্রতিযোগিতায় উত্তরবঙ্গের লোক আঙ্গিক PALATIYA কেন্দ্রিক প্রযোজনার সূত্রে ২০১৯ সাল থেকে তার নিয়মিত থিয়েটারে যুক্ত হওয়া। অবশ্য তার আগে স্কুল জীবনে থিয়েটার করার অভিজ্ঞতা তার ছিলই।
নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে মৌসমী খান -এর বাবা দর্জির কাজের সঙ্গে যুক্ত। সেই পরিবারের মেয়ে লেখাপড়ায় স্নাতকোত্তর শেষে শিক্ষণ শিক্ষণ এর সাথে বর্তমানে যুক্ত।কিন্তু পাশাপাশি অভিনয়টা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের আর্থিক অস্বাচ্ছন্দকে উপেক্ষা করেই লেখাপড়ার পাশাপাশি থিয়েটারে যুক্ত হয়েছে সে। একসময় তার মনে হয়েছিল কোন থিয়েটারের দলে যুক্ত হলে অর্থ প্রয়োজন হয়। কিন্তু সৃষ্টি মাইম -এর সব্যসাচীবাবু যখন তাকে থিয়েটারে যুক্ত হতে বলেন, তখন সে জেনেছিল তাঁদের সাথে থিয়েটার করলে অর্থ লাগে না।তাই থিয়েটারে যুক্ত হয়ে সে অন্য আনন্দের একটা পৃথিবী খুঁজে পেয়েছে।শিল্পের প্রতি একটা অমোঘ টান থেকেই সে থিয়েটারে যুক্ত হয়েছিল।
স্কুলে বেশ কিছু নাটক করলেও “মৃগয়াগাঁথাই” তার কোন দলে অভিনীত প্রথম নাটক। সৃষ্টি মাইম থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত থেকেই সে থিয়েটার করে চলেছে। “আস্তা করিবার সোগায়ে চায়, প্রধান ভাবে কি উপায়ে” নাটকটি ২০১৮ সালের কলা উৎসবে অভিনীত হয়েছিল। এটাতে প্রধানের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিল মৌসমী। প্রতিমা নামের এই চরিত্রটি ছিল এক ভারতীয় নারীর চরিত্র। কিন্তু সেই প্রতিমাই তার সরল সাদাসিধা চরিত্র থেকে বেরিয়ে গাছ কেটে রাস্তা বানাবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। সে প্রতিবাদী হয়েছিল তার প্রধান স্বামীর বিরুদ্ধে
তাই এই চরিত্রটিই তার প্রিয় চরিত্র। মৌসমী এখনও পর্যন্ত সৃষ্টি মাইম থিয়েটারেই অভিনয় করে চলেছে। এ পর্যন্ত যতগুলো নাটকে অভিনয় করেছে তার সবগুলোই এই সৃষ্টি মাইমে।
থিয়েটারের জগৎটা মৌসমীর একটা ভালবাসার জগৎ। প্রতিদিনের জীবনটা তার কাছে যেমন একটা জীবন, তেমনি থিয়েটারের জীবনটাও তার কাছে আর একটা জীবন। এক জীবনে শরীর আর এক জীবনে মন। থিয়েটার তার মনের দুনিয়া বলে সে মনে করে। থিয়েটারে এক জীবনে থেকেই অনেক জীবন যাপন করা যায়।
বাড়ির মানুষজন তার থিয়েটার করার কাজকে মেনে নিয়েছে বলে সে জানিয়েছে। যখন প্রথম দিকে থিয়েটার করে ফিরতে তার রাত্রি হয়ে যেত, তখন কিছুটা সমস্যা হলেও সেই সমস্যা এখন আর নেই।
থিয়েটার করে কি বাঁচা যায়?… এই প্রশ্নের উত্তরে মৌসমী জানিয়েছে, উত্তরবঙ্গে এখনও সম্ভবত থিয়েটার করে বাঁচার স্বপ্নটা সত্যি হওয়া একটু কঠিনই। তবে থিয়েটারটা মন দিয়ে করলে প্রাণ খুলে বাঁচা যায়। এই বাঁচাটা অন্যরকম।এর সঙ্গে থিয়েটার করে উপার্জনের কোন সম্পর্ক নেই।তার কাছে থিয়েটার আসলে বাস্তব জীবনের সত্যতা ও কাল্পনিক জীবনের ভাললাগার জায়গাগুলোর একটা উজ্জ্বল উদাহরণ।
এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি নাটকে (মূকাভিনয় আশ্রিত নাটক) অভিনয় করেছে সে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : মাসান, আস্তা করিবার সোগায়ে চায় – প্রধান ভাবে কী উপায়ে, মৃগয়াগাথা, সামান্য ক্ষতি, Ohh Corona, গোয়েন্দা নীরু গোঁসাই, Save Water, মিত্রোঁ, The Proposal,Black majic, ওরা কাজ করে, Gloomy Sunday, Justice ইত্যাদি।
লেখাপড়া, আর্থিক সমস্যা ইত্যাদিকে ডিঙিয়ে মৌসমী থিয়েটারটাকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে উত্তরবঙ্গে নিজেকে পরিচিত করিয়েছে। এটা তার কাছে অন্যরকমের একটা আনন্দ। পাশাপাশি লেখাপড়াটাও চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে জীবনে স্বাবলম্বী হয়ে সংসারের প্রয়োজনে লাগে। থিয়েটার করার মত পরিস্থিতি বা অনুকূল পরিবেশ না থাকলেও থিয়েটার নামক মাধ্যমটির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে এক আনন্দের জগতের সন্ধান পেয়েছে উত্তরবঙ্গের থিয়েটারকর্মী মৌসমী।