দুলাল চক্রবর্ত্তী
গত ২৯ জানুয়ারি বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে শুরু হয়ে ছিল বহরমপুর অ আ ক খ দলের বার্ষিক নাটকের উৎসব। চলেছে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। অভিনীত হয়েছে সর্বমোট ৫টি নাটক। তার মধ্যে শুরুর দিনেই মঞ্চস্থ হয়েছিল নাটক মান্য গণিকা। এটি বহরমপুর অ আ ক খ দলের সাম্প্রতিক নির্মাণ।
নাটক লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন প্রান্তিক দত্ত। জাঁ পল সার্তের Respectful prostitute কে আশ্রয় করে অন্য একটি দেশীয় ধর্মীয় মৌলবাদের মুসলিম বিদ্বেষ সংক্রান্ত একটি বাস্তব ঘটনা, গল্পের আকারে নাটকে এসেছে। যেখানে লিজা নামের এক সুন্দরী দেহোপজীবিনীর সাথে অকারণে হত্যা জনিত রাষ্ট্রীয় সংঘাত দেখানো হয়েছে। অনন্ত যোশী, আমন যোশী পুলিশ অফিসারের যোগসাজশে ক্ষমতাসীন চক্রান্তের পর পর কিছু ঘটনা এই নাটকে ঘটে যায়। ঘটনা ক্রম দেখায় গৈরিকীকরণ প্রক্রিয়ায় হিন্দু ধর্মীয় মৌলবাদের থাবা, কত সুক্ষ্ম দাবার চালে এগিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু ছত্রে ছত্রে আছে বিষ মাখানো সূচালো মৃত্যু ফলা আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করার গুপ্ত উদ্দ্যেশ্য। জাতপাতের আর ধর্মীয় বিভেদের রূপরেখা রচনা করতে রামায়ণ থেকে উঠে আসা হনুমানের লেজের আগুনের লকলকে শিখায় ধ্বংসের দিকে উজ্জ্বলতা পাচ্ছে ভারতের রাজনীতি। ভক্তির বাইরে নাশের জন্যে চুপিচুপি উঠে আসছে ফ্যাসিস্ট দাপট। নাটকের নিরুত্তাপ গল্প ক্রমেই এ ভাবে মৃত্যু হোমানলের কোপে পড়েছে। কারণ, নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র লিজার সাথে বন্ধু হয়ে মিশে থাকা সেজাদ আলমের সম্পর্ক ঘিরেই হিন্দু মুসলিম বিতন্ডা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
কাশ্মীরের সেই পুলওয়ামা জওয়ান মৃত্যুর অব্যবহিত ৭ দিন পরে একটি পানশালায় জনৈক মুসলিম বিদ্বেষী যুবক, অনুজ শর্মার হাতে হঠাৎ সেজাদ আলমকে লক্ষ্য করে ছুটে যাওয়া গুলি গিয়ে বিদ্ধ হয় আরেক মুসলিম তরুণ সিরাজ সেখের বুকে। ঘটে এক হত্যা। এই হত্যা ঘিরেই ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে জীবিত লিজা ও সেজাদ আলমের দিকে ষড়যন্ত্রের তীর ঘুরিয়ে নিয়ে যাবার মত রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন চেপে বসে। মুসলিম সন্ত্রাসী তকমা দিতেই রাষ্ট্র নায়কেরা দল বেঁধে হিন্দুর হাতে মুসলিম হত্যার চেহারাকে ভিন্ন চেহারা দিতে চায়। জনমতকে আশ্বস্ত করতে সেজাদ আলমকে হত্যাকারী সাজাতে তৎপর হয়। মূল ঘটনা এই টুকুই।
ফ্যাসিবাদের উত্থানে একটি দুরন্ত ঘটনা। টানটান ও নাটকীয় বিষয় বস্তু আছে এই গল্প বৃত্তে। নাট্যের পরিবেশন পন্থায় তিনটি ত্রিভুজাকৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত টুকরো ঘটনা মঞ্চে বারবার পর্যায়ক্রমিক ভাবে আলো জ্বলা নেভায় সামনে এসেছে। লিজা আর সেজাদ আলম একদিকে, অন্যদিকে মেজর দুই সাংবাদিক এবং শিবরাজ খের, একেবারে কেন্দ্রে অনন্ত যোশী, আর্দালি, আই এ এস মোহিনী, পরে পুলিশ অফিসার এবং আমন যোশী। যাতে রীতিমতো সাসপেন্স বর্তমান। কিন্তু কোথায় যে তা তুলনায় কম দানা বাঁধে। সেখানেই হলোটা কী বলে জিজ্ঞাসা ভীড় করে।
তাই বিভ্রান্তি বিচ্যুতি খুঁজে চলেছি। ভাবতে বসে পেলাম, নাটকের মূল অস্তিত্বের পথে কী কোন বাড়তি যোগান এসে নাটকের চলমানতাকে বিব্রত করেছে? করতেও পারে, কেননা মঞ্চ ফ্লোরে চলা এই তিন কৌণিক স্ট্রাকচারের মাথায় ছিল প্রোজেক্টর। সেখান থেকে সিনেমাটোগ্রাফিতে আসে ভারতের কাশ্মীর সমস্যার আদ্যোপান্ত অতীত পরিপ্রেক্ষিত। যার মধ্যে আছে সপক্ষে বিপক্ষের গভীর অন্তর্তদন্ত। দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে ইতিহাসের পাতায় আজ পর্যন্ত কাশ্মীর ঘিরে যে ভিন্ন ভিন্ন হিন্দু মুসলিম বিবাদের হেতু ছড়িয়ে আছে, সেই ব্যাখান।
মনে হয়েছে এই প্রক্ষিপ্ত অবগতি হয়তো লিজা আর সেজাদ আলমের সাথে ঘটা ঘটনার চলমানতাকে আহত করছে। তাই এইসব সূত্র ধরিয়ে দেওয়া প্রোজেক্টর প্রক্ষিপ্ত তথ্যগুলোর কিছু বাড়তিতে দর্শনের দৃষ্টি পড়ায় নাট্য অবগতির খামতি হয়ে গেছে না-কি, যাচ্ছে না-কি, সেই প্রসঙ্গ একটু তলিয়ে দেখা দরকার। ইতিহাসের বিস্তার, মঞ্চ ভূমিতে ঘটমান বর্তমান নাট্য ক্রিয়ার পরিপন্থী হলো কিনা তা বুঝে নেবার প্রয়োজন আছে। স্বীকার করছি এই ইতিহাসের এই জ্ঞাপনও প্রাসঙ্গিক। তাও কতটা কীভাবে আসবে অতি অবশ্যই মেপে দেখতে হবে। কারণ সব মিলিয়ে মূল গল্পের তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে বলে, ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে।
তথাপি তিন মাসে প্রায় শতাধিক নাটক দেখেই বলতে পারি, মান্য গণিকা এই সময়ে প্রযোজিত গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ সাতটা নাটকের মধ্যেই আছে। সময়ের জরুরি কথায় নাটকের প্রতিপাদ্য আদ্যোপান্ত মোড়ানো ছিল। আমরা ক্রমেই ভিসুভিয়াস এর স্তুপে দাঁড়িয়ে সুখী হতে চাইছি। আগামী কাল কি ঘটবে তা নিয়ে ভাবুকেরা সশঙ্কিত আছেই। তাই আজ দেশের আভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিয়ে যে দল রাজনৈতিক দৃষ্টিতে কিছু বলতে চেষ্টা করছেন, তা অতি অবশ্যই বরেণ্য এবং সাধুবাদ যোগ্য প্রয়াস। এই কারণেই মান্য গণিকা নিয়ে লিখছি যাতে এইসব নাটকের ক্রম দায়বদ্ধ মঞ্চায়ন বাড়ে।
মানুষের মধ্যে অলস বিবস করে চলা মানবতা বিরুদ্ধ ধর্মীয় উন্মাদনার অন্ধত্ব সময়ের প্রেক্ষিতে যাতে ভাবনার আলো পায়। তবে যে কারণেই হোক কিছু দর্শকের এই প্রযোজনা বোধগম্যতায় কঠিন লেগেছে। তাই ব্যাপারটা কি হলো ভাবতে বসেছি। যেহেতু এটিই অ আ ক খ দলের এযাবৎ নির্মিত শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা। অতএব নাটককার নির্দেশক প্রান্তিক দত্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। তিনিই আমার এই চিন্তার বিরুদ্ধে যুক্তির জোগান দিয়ে প্রযোজনার সারল্য সুরক্ষিত করতে পারেন।
অভিনয় প্রসঙ্গে গণিকা লিজা / ঈশানী সরকার, অনন্ত যোশী / সুমন সিং রায়, আর্দালি ও অনুজ শর্মা / প্রীতম রায়, আমন যোশী / সোমনাথ ভট্টাচার্য, আই এ এস মোহিনী / ঝিমলী দেবকুমার চক্রবর্তী, ১ম সাংবাদিক / শাহনাজ বেগম, ২য় সাংবাদিক / সমর সাহা, শিবরাজ খের ইন্দ্রনীল রায় প্রমুখেরা খুবই আন্তরিক তাগিদ থেকে তাদের নিজস্ব চরিত্রায়ন করেছেন। নির্দেশক নাটককার যে অবস্থানে চরিত্রগুলিকে আলোকিত ও আলোচিত করেছেন। সেই বৃত্তেই এঁরা সবাই তাঁদের বেষ্ট টুকুই দিয়েছেন। সাবলীল স্বাভাবিক অভিনয়ে উজ্জ্বল সকলেই। ভারী ভারে তলিয়ে আছে সুমন সিংহ রায়ের অনন্ত যোশী।
তবে এই চরিত্র কূটনৈতিক চালের কুটিল-কৌটিল্য হলে বেশ হতো। বাদ বাকি সেজাদ আলম / অমিত মন্ডল, অরবিন্দ ঢোলাকিয়া / অরুণ কুমার দাস, মেজর / দিলীপ রায়, সিরাজ সেখ অরূপ মন্ডল মানবাধিকার কর্মী / পিয়ালী সরকার ও পুলিশ অফিসার প্রান্তিক দত্ত হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছেন। নাটকের জন্যে এঁদের ভূমিকা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। আলোতে শ্যামা প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়, রূপসজ্জায় তিলক বন্দোপাধ্যায়, পোষাক ঈশানী সরকার, ভিডিওগ্রাফি পার্থ দাস প্রমুখেরা আঙ্গিককে সুন্দরভাবেই প্রযুক্ত করেছেন। সব মিলিয়ে মান্য গণিকা নাটকের বিবিধ পর্যালোচনা সাপেক্ষে। সর্বজনের মান্যতা কামনা করছি।