নৈতিক রায়
একটা সময় অভিনয়ের জন্য মেকআপের কোনো প্রচলন ছিল না। চরিত্র নির্মাণের জন্য মুখোশের ব্যবহারই ছিল একমাত্র উপায়। প্রথম অভিনেতা হিসেবে বিবেচিত থেস্পিস তার মুখ আঁকার জন্য সাদা সীসা ও ওয়াইন ব্যবহার করতো। এরপর মধ্যযুগীয় ইউরোপে অভিনয়ের জন্য তাঁদের চেহারাকে ভিন্ন ভিন্ন রঙে রাঙিয়ে রাখতেন। ভগবান সাজাতে হলে সাদা রঙের ব্যবহার হোত। ভগবানের দুত বোঝাতে মুখমণ্ডল লাল করা হতো।
এরপর স্টেজ লাইটের ব্যবহারের সাথে সাথে অভিনেতার মেকআপের ব্যবহারের দরকার হয়ে পড়ে। প্রথমে মঞ্চে আলো হিসেবে মোমের আলো বা তেলের বাতির আলোর প্রচলন থাকায় সেখানে মুখমন্ডলকে হাইলাইট করার দরকার হল। এরপর আলোর বিবর্তনের সাথে রূপসজ্জার প্রয়োজন ও পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য এই মাধ্যমকেও তাতে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে।
স্টেজ মেকআপ ইতিহাস (Stage Makeup History)
প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসেই স্টেজ মেকাপের ব্যবহার রয়েছে। গ্রীক থিয়েটারে অভিনেতার মুখোশের ব্যবহার করে চরিত্র নির্মাণ নিজেদেরকে প্রস্তুত করতেন। গ্রীক ও রোমান থিয়েটারে খুব বড় বড় মুখোশের ব্যবহার হোত, যা দিয়ে অভিনেতাদের বিভিন্ন চরিত্রে রূপান্তরিত করা হত।
একজন অভিনেতা একাধিক ও ভিন্ন রূপের মুখোশের ব্যবহারের সাথে সাথে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেতেন, কিন্তু এতে অভিনেতার মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি দেখার সুযোগ ছিল না দর্শকদের কাছে। অতএব মুখের অভিব্যক্তিকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেবার একটা প্রয়োজন অনুভব করল তখনকার অভিনেতারা।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই মুখোশের আদল সরাসরি মুখের ওপর আঁকার ইচ্ছা ও তার প্রয়োগ তাঁদের মাথায় এলো। এক্ষেত্রে শিল্পীদের এই কাজে এগিয়ে আসার ইতিহাসও সুবিদিত। ইংল্যান্ডে ১৫০০ থেকে ১৬০০ -এর মধ্যবর্তী সময়ে মুখের নির্দিষ্ট বৈশিষ্টগুলিকে মাথায় রেখে থিয়েট্রিকাল মেকআপের ব্যবহার শুরু হল। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মুখমন্ডলকে হাইলাইট করা।
এক্ষেত্রে উজ্জ্বল সাদা রঙের ব্যবহার ও মুখের নকল দাড়ির ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হত। রঙের পাশাপাশি তাকে লাইন দিয়ে আকার জন্য ভারতীয় কালি সহ সাদা পাউডারের ব্যবহার এবং গালকে উজ্জ্বল করার জন্য গোলাপী রঙ বা রুজের ব্যবহারও হত। এইসবই সেই সময়ের মেকআপ কিটের মূল উপকরণ ছিল।
একটি বিশ্বাস বা কথকতা থিয়েটার জগতে রয়েছে যে থেস্পিস, খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রীক থিয়েটারে কোরাস থেকে বেরিয়ে আসা প্রথম অভিনেতা, যিনি তার মুখ সাদা সীসা ও ওয়াইন ব্যবহার করে এঁকেছিলেন এবং এইব্যাপারে তাকেই অগ্রজ ভাবা হয়।
থিয়েটারে মেকআপের গুরুত্ব (Importance of Makeup in Theatre)
মেকআপ নাটক তৈরি, চরিত্র নির্মাণ, সেই চরিত্রের দর্শনগত নান্দনিকতায় বা ভিসুয়াল এস্থেটিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আগেই বলা হয়েছে মেকআপের সঙ্গে পোশাকের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। নাটক বা সিনেমা শিল্পে এই দুটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
চরিত্র গঠন বা নির্মাণ- যথাযথ মেকাআপ দর্শক মনে সেই চরিত্র বুঝতে সাহায্য করে, সেই চরিত্রের প্রাথমিক তথ্য দর্শকের মস্তিস্কে স্থান পায়। এবং খুব স্বাবাবিকভাবেই উপস্থাপীত নাটকের গল্প শোনা বা বোঝার ক্ষেত্রে বাস্তবতা বাড়াতে সাহায্য করে।
নাটকের সেটিং সম্পর্কে ধারণা- নাটকের মেকআপ সেই চরিত্রের স্থান, কাল ও চরিত্রের প্রধান ও উল্লেখযোগ্য নির্দেশক। পোশাক অর্থাৎ কস্টিউমের সাথে সাযুজ্য রাখলে তা মেকাপের সাথে সমন্বয় করতে সক্ষম হবে।
মেকআপ শিল্পীর লক্ষ্য অভিনেতার ত্বকে প্রবেশ করা- ত্বকগুলিতে নতুন চরিত্রের প্রাণের সঞ্চার করা এই শিল্পীর প্রধান কাজ। সেটা না করতে পারলে তা নাট্য নির্মাণে ব্যহত হয়। শুধু সংলাপ বলা বয়া মিউজিক দিয়ে কোনো মঞ্চ নাটকের সঠিক প্রয়োগ সম্ভব নয়। তাই মেকআপ শিল্পীকে অভিনেতার ত্বকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হবে, চরিত্রের ধরন-ধারণ না বুঝতে পারলে সে সেইকাজে সফল হনে না।
ভিস্যুয়াল এফেক্ট- মেকাপের দৃশ্যমানতা এবং নান্দনিকতায় অভিনেতার মুখমণ্ডলের বৈশিষ্টগুলি সহজ ও উজ্জ্বল করে তুলতে আলোর প্রয়োগ যাতে ব্যহত না হয়। অর্থাৎ আলোর প্রভাবে সেই চরিত্রের ভিস্যুয়াল উপস্থাপনার জ্ঞাণ থাকা বাঞ্চনীয়।
মেকআপের প্রাথমিক প্রয়োগ (Basic Application of Makeup)
সঠিকভাবে ফাউন্ডেসন ব্যবহার করতে হবে, নয়তো মঞ্চে আলোর মুখের ওপর খেলা করবে না, হয় মুখমণ্ডল অন্ধকার দেখাবে, নয়তো আলো বিকিরণের জন্য মেকআপ করা অংশ ফ্যাকাশে দেখাবে। মঞ্চে আলোর ঘনত্ব পরিবর্তনশীল, তাই এমন একটি টোনে তাকে সাজাতে হবে, যাতে করে সেই মেকআপ করা চরিত্রটি সঠিকভাবে দর্শকের সামনে প্রতিভাত হয়।
শুধুমাত্র মুখমণ্ডলে ফাউন্ডেসন দিলে হবে না, ঘাড়, কান গলাতেও তা দিতে হবে। ত্বকের ভাষাকে পরিপূর্ণ করতে রুজ ব্যবহার করা হয়, যা গালের মাঝখান থেকে শুরু হয়, শেষ কানের নীচের অংশে। ভ্রু এবং চোখের মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি নিরপেক্ষ শেড ব্যবহার করতে হবে। এই শেড মুখের সামগ্রিক টোনের সাথে সাযুজ্য রেখে নানা রকমভাবে ঘন ছায়া তৈরী করে নিতে হবে।
আই লাইনার চোখকে সংজ্ঞায়িত করবে, লাইনগুলি যত ঘন হবে চরিত্র তত নাটকীয় হবে। লিপ লাইনার আর স্টিক, চরিত্রের প্রয়োজনে আঁকতে হবে, এক্ষেত্রে ঠোঁট কেটে রক্ত ক্ষরণ দেখাতে, সেই জায়গাটা বিশেষ ভাবে ক্ষতের প্রতিরূপ চিত্রায়িত করতে হবে। সবই মেকআপ আর্টিস্টের শৈল্পিক দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে। সামগ্রিক মেকাপের ওপর ট্রান্সলুসেন্ট পাউডার ডাস্ট ব্যবহার করে ফাইনাল সেট করে দিতে হবে। যার আলোক বিকিরণ রোধ করবে আর মেকাপের স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
হাইলাইট করার কারণ (Highlight of Makeup)
মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে হলে মুখের অভিব্যক্তি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া নাটকের প্রথমিক উদ্দ্যেশ্য। যেহেতু মঞ্চ নাটকে আলোর ব্যবহার করা হয়, সেই জন্য আলোর ওপরই নির্ভর করে, মেকআপ কীরূপ হবে। মুখের অভিব্যক্তি ও তা দর্শকাসনে বসে থাকা দর্শকের কাছে সঠিক ভাবে উপস্থাপন করার জন্য নাট্যচরিত্র অনুযায়ী সেই মুখের সজ্জা নির্ধারিত হবে।
মেকআপ ও আলো (Makeup and Light)
আবারও বলা দরকার মঞ্চের আলোর সঙ্গে মেকআপের নিবিড় যোগাযোগ। মেকআপের ঘনত্ব বা রঙ না ঠিক হলে সেই চরিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে না।
মেকআপে আলোর প্রভাব – গোলাপী শীতল রং ধূসর করে এবং উষ্ণ রংকে তীব্র করে। হলুদ আরও কমলা হয়ে যায়। মাংস গোলাপী চাটুকার সবচেয়ে মেকআপ। আগুন লাল মেকআপের ফলে গাঢ় মাংসের টোন বাদে সমস্ত কার্যত অদৃশ্য হয়ে যায়। হালকা এবং মাঝারি রুজগুলি ফাউন্ডেশনের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে যায়, যেখানে গাঢ় লাল রুজগুলি লালচে বাদামী হয়ে যায়। হলুদ কমলা হয়ে যায়, এবং শীতল ছায়ার রঙগুলি ধূসর এবং কালো হয়ে যায়।
মেকআপের ধরন (Type of Makeup)
কোন চরিত্রের কি মেকআপ হবে, সেটা নির্ভর করবে সেই চরিত্রে বয়স, শ্রেণী, স্বভাব প্রভৃতির ওপর। সাধারণ মুখমণ্ডলের ঠান্ডা টোন ইঙ্গিত করে, কিন্তু সেখানে লাল, কমলা ইত্যাদি রঙের ব্যবহারের ফলে মুখের উষ্ণতা বাড়ানো হয়।
এই মেকআপের সঙ্গে পোশাকেরও একটা সংযোগ আছে। কারণ সেই দৃশ্যের মুড ও চরিত্রের টাইপ বা সেই পরিস্থিতিতে অভিনেতার অভিব্যক্তি সব বিবেচনা করেই মেকআপ করা হয়। মেকআপ তেল ও জলের ওপর নির্ভর করে করা হয়, জলের ওপর নির্ভর করে মেকআপ করলে তাকে দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব, কিন্তু ওয়েল বেস হলে তার দ্রুত অপসারণ সম্ভব নয়। যা দ্রুত চরিত্র বদলের ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ।
পেশাদার মেকআপ কিট ও তার উপকরণ (Professional Makeup Kit)
উপকরণ- ফাউন্ডেসন (ফর্সা, মাঝারি এবং গাঢ় শেডের) বিভিন্ন ধরনের রঙ (গাল, ঠোঁট, চোখের নিচের ছায়া), আই লাইনার পেন্সিল, হাইলাইটিং আই ক্রিম, লিপ পেন্সিল, ট্রান্সলুসেন্ট পাউডার, ফোম স্পঞ্জ, পাউদার পাফ, ব্লটিং পেপার, অ্যাপ্লিকেটর, মেকাপ রিমুভার, পরচুল, পাটের চুল, স্পিরিট গাম, কৃত্তিম দাড়িগোঁফ, প্যালেট ইত্যাদি।
মেকআপ শিক্ষা (Makeup Education)
এই শিল্প চর্চাটি না শিখে করা সম্ভব নয়। এই শিক্ষাপদ্ধতির সাথে সেই মেকআপ আর্টিস্ট কে ছবি আঁকায় ঝোঁক থাকা ভালো নয়তো সে চরিত্র চিত্রণে নিজে দক্ষ প্রমাণ করতে পারবে না। এখন শহর বা বিভিন্ন রাজ্যের সদরে বেসরকারি অনেক সংস্থা আছে যেখানে এই স্টেজ বা ফিল্ম মেকআপ শেখানো হয়।
আঁকার ধারণা বা দক্ষতা থাকার সঙ্গে সঙ্গে ভাস্কর্যের প্রতি ঝোঁক বা কারিগরি দক্ষতা থাকা খুব দরকার। আলো সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা থাকা খুব জরুরি। এসবেরই যথাযথ ট্রেনিং নেওয়া খুব দরকার। এক্ষেত্রে আমাদের এই বাংলায় বিভিন্ন নাট্যদলের উদ্যোগে নানান ওয়ার্কশপ করা হয়, সেখানে যারা নতুন করে শুরু করতে চাইছেন তাদের সেই ওয়ার্কশপে যোগদান করা উচিত।
একটা কথা মনে রাখা উচিত নিজস্ব ধারণা ও দেখে শেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে পেশাদার মেকআপ আর্টিস্ট করা সম্ভব নয়। কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে একটি কারিগরি দক্ষতা বা টেকনিক্যাল এফিসিয়েন্সির ওপর নির্ভর করা একটি কাজ।
এক্ষেত্রে একজন মেকআপ শিল্পীকে স্কিন কেয়ার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। এক্সপায়ার ডেট এর বেস বা পাউডার বা অন্যান্য মেকাপ এপ্লিকেশন যদি ব্যবহার করেন তাহলে অভিনেতার ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই শিল্পীই দায়ী থাকবেন। আমাদের নাটকের মেকআপ শিল্পীদের সেরকম কোনো লাইসেন্স বা জব কার্ড কিছু নেই, সবটাই তার দক্ষতা ও পরিচিতির ওপর নির্ভর করে করা হয়।