দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা
সে এক মেয়ে। তাকে তার বাবা বুঝিয়েছিল ওই শূন্য আকাশের আলোকিত রশ্মিতে জীবনের ওপারে থাকা অন্য আরেক আকাশের ভাষা। জানিয়ে ছিল উদার উদাত্ত উদাস হয়ে পৃথিবীর অস্তিত্বের সাথে সহবাস করার পথ। চিনিয়েছিল বাঁচার জেদ কাকে বলে। তার সাথে ধ্রুব তারা সপ্তর্ষীমন্ডলের ভেতরের গাঢ় রহস্য। কোলে বসে মেয়ে বুঝেছিল জীবনের অসীমে অজানা কোণে পড়ে থাকা অন্ধকারে বসেই কিভাবে আলোর গভীরে কান পেতে অনন্তের যাত্রা ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু একটা টেলিস্কোপ লাগে। দূরবীন তো লাগেই…..
দিনের পরে আসে রাত। আর রাতের অন্ধকারে নিশ্চুপ আকাশে ফুলঝুরি উড়ে পড়ে চারিদিকে। মায়া ভরা তারারা সারা রাতে কিভাবে জেগে থাকে। কি ভাবে হাসে কথা বলে, কি কথা বলে? কার কথা বলে? এই অন্ধকারে অতলে মাটির পৃথিবীতে যে দূষণের আলোর বিরুদ্ধে নামান্তর অন্ধকারের কান্নায় কি ওরাও আকাশে বসেই সব দেখে আর কাঁদে? না-কি কিছুই বলে না। শুধুই তাকায়। চুপচাপ দেখে তাই উজ্জ্বলতায় তাকায় শুধু। এইসবের গোলমালে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া মেয়ে কি শুধু তারারই নেশায় পড়ে গেছিলো? সেই মেয়ে অভাবেই স্বভাব হারায় নি। মায়ের বকুনিঝকুনি খেয়েও। সে আছে ছাদের উপরে মস্ত ছাদের আচ্ছাদনের তলায়। তারায় ভরা রাতে বলে না-কি হারিয়ে গেছি আমি। তাই ভাললাগার ভাল গুলি উড়ে এসে ভালভাবে ঝরে পড়ে। তবুও সে মহাকাশের মহাকাব্যের সব অধ্যায় পড়তে পারে না। নজরে সব আসে না বলেই অনেক কিছুই দেখতেও পায় না। তাই একটা দূরবীন বা টেলিস্কোপ কিনতে চায়।
মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নিল আকাশেও কি এই জট পাকানো এক জটিল আবর্ত সামাজিক ভাবে ঘিরে রেখেছে? মন পসন্দ কোন উত্তীর্ণ উত্তরে কি কারো কোন ভ্রমণ সম্ভব নয়? মানুষ হয়ে জন্মেও মানুষকে, কেবলই মানুষের চক্রান্তেই পড়ে পড়ে মরতে হবে? চলমান সংস্কার, প্রথা, কুপ্রথা আর লোভ, লালসা, অমানবিক ছলনায় অন্যের মানসিক অত্যাচারে ক্লীবত্ব নিয়েই বাঁচতে হবে? তবে পরিত্রাণ কোথায়? হাহাকার অন্ধকার ওপার এপার মিলেমিশে একাকার। তাই অকালে বাবা আকাশ চিনিয়ে পরপারে চলে গেছে। বাপ হারা মেয়েও ভেবেছে আকাশলীনা হবে। সবই ওই চাওয়া আর চেয়ে থাকা। অন্যভাবে মুক্তির আকাশ। চেয়েছিল তার মাও। কিন্তু বিধবা মা, কোনক্রমেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে ছিটকে পড়েছিল। শশুর বাড়িতে মেয়ের কপালে জুটেছে স্বামীর অকাট কাঠ পুতুলের সহবাস, যে আবাসের পুরুষের হাত নেই, মর্ম নেই, করনীয় নেই আছে হরেক খিদের জেদ। এই পুতুলের মাথার রঙ চটা বিবর্ণ গোলাপ যেন। খেলনা।
কিন্তু খেলা জমে না। রাতের বিস্বাদ অভিসার আছে মরা ভরা এক পানা পুকুরে দলে চাপা। চাপের চাপ, চাপান উতোর জীবন। প্রেম নেই। আছে রক্ত পানের নেশায় কাপালিক মাতৃভক্তি। যেখানে জেহাদ দেন গুরুদেব বা পূজারী পন্ডিত। গর্ভবতী মেয়ে হবে মা। পেটে আছে কন্যা সন্তান। অতএব দ্রুণ হত্যার আদেশ আসে। সু্যোগে পালায় মেয়ে। তার চাওয়া অন্য। আকাশী-নীল স্বপ্ন ভরা এক প্রার্থীব্য আকাশকে পেটের গর্ভে নিয়েছে সে। তাই দুয়োরাণী দুয়োধ্বনি শোনে। তবুও বেশ কষ্টে সেই মেয়ের দিব্যি ফুটফুটে মেয়ে জন্মায়। বড়ও হয়। সেও টেলিস্কোপের কাঙাল। কেবলই দূরবীন চায়। সেও আকাশকেই চায়, তারাদের চিনে নিয়ে বন্ধুত্ব পাতাতে চায়। ওই নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর পরে ওই নীল আকাশ মিলেমিশে যুগের পরে অন্য যুগেও মায়াবী স্বপ্নের ছটা।
মধুসূদন মুখোপাধ্যায়ের মনের আবেগের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত অনুভূতিগুলিকে নিয়ে কালটিভেট করে লেখা টেলিস্কোপ নাটক মুগ্ধ করেছে। মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটারের ছাত্র সানি চ্যাটার্জী খুব ভাল ভাবেই এই টেক্সটের টেক্সটাইল বুননে রং-তুলির দাগ কেটেছেন। যে কিনা এক আগাম সম্ভাবনা। একটি মনবিক শুদ্ধস্বরের মালিক। পরিচালক হিসাবে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। অনেকগুলো চরিত্রে শ্যামবাজার নাট্য চর্চাকেন্দ্রের তিন কুশীলব ভিন্ন চরিত্রায়ন করেছেন। সকলেই দক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রী। সব চরিত্রায়নই আলাদা লাগলো। তাই সমরেশ বসু, মৃত্তিকা বসু এবং প্রীতি কর্মকার, এই তিনজনই অভিনীত চরিত্রে অনিন্দ্য সুন্দর ও হৃদয় বৃত্তিতে ভরপুর বলে মনে হয়েছে।
অনুভব খাটো আর খাটুনি বৃথা, এমনটা একেবারেই নয়। সাথে অনুপ হালদার ও অরিন্দম দে’র যৌথ মঞ্চ সামান্য দেখায় কিন্তু অসামান্য কাজের। যে মাঠে খেলা হয়, আরো হবে। পাশাপাশি সৌমেন চক্রবর্তীর আলো চমৎকার ভাবে আবেগগুলিতে মিশেছে। অন্তর মম বিকশিত করো অন্তত তাই। মধ্যে জুড়েছে অন্য বোধ। উষর আচার্য, যোগমায়া বসু, চৈতালী সরকার, সান্ধ্যদীপ বসু, সৌমেন মজুমদার, রিপন পাল, গোপা দে, সৌপর্ণ পাত্র, শুভ্র ভট্টাচার্য, এরা সবাই সবাইতে মিশে আমাদের আকাশের মতো হতে বলে গেছে। নয়তো আকাশের আভাসে প্রভাসের ভাষায় শিক্ষিত করেছে। টেলিস্কোপ খুব অনুভবি নাটক। মাপে চলা বাংলা নাটকের ম্যারাপের ম্যাচে ঠিক মতো নাচবে, নাচতে পারবে? কি জানি……. অনুভবের বারান্দায় মোবাইলে চোখ রেখে টেলিস্কোপের নজরে চাঁদটা দেখা একটু তো কঠিন বটেই।