বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম : পর্ব ১৮
কলকাতা রঙ্গশীর্ষ নাট্যদলের কর্ণধার ও নির্দেশক মনোজিৎ মিত্র একসময় ভাল চাকরি করত। কিন্তু থিয়েটারের টানে একসময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরো সময়ের থিয়েটারকর্মী হয়ে উঠেছে। হাঁ, শুধুমাত্র থিয়েটার নামক মাধ্যমকে ভালবেসে এমন একটা সিদ্ধান্ত সে নিতে পেরেছিল। সেই মনোজিতের সবসময়ের ধ্যানজ্ঞান থিয়েটার। ২০১১ সাল থেকে মনোজিৎ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। ছোট থেকেই তার ইচ্ছা ছিল একটা অন্য পথে হাঁটা। আর সেই ইচ্ছা থেকেই থিয়েটারের পথে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। একসময় চাকরি করলেও সেটা তার ভাল লাগেনি। থিয়েটারকে ভালবেসেই চাকরির নিশ্চিত জীবন থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে থিয়েটারের মন্ত্রে নিজেকে দীক্ষিত করে সেই পথেই হেঁটে চলেছে। অভিনয়ের প্রতি একটা টান থেকেই এমন সিদ্ধান্ত, এ কথা জানিয়েছে মনোজিৎ। পরবর্তীতে নিজে নাটকের দল তৈরি করে থিয়েটার চালিয়ে যাচ্ছে।
তার থেকে বয়সে বড় অথচ বন্ধুপ্রতিম শৈবাল বিশ্বাসের হাত ধরে থিয়েটারে এসেছিল মনোজিৎ। নহলী দলে তার প্রথম থিয়েটার করার অভিজ্ঞতা। সেখানে বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করার সূত্রে থিয়েটারের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন প্রেম তৈরি হয়েছিল তার। অবশ্য তার আগে স্কুল – কলেজে থিয়েটারের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা তার জীবনের ঝুলিতে ছিলই। সেই জীবনে তার অভিনীত নাটকগুলি হল : ভীম বধ, জুতো আবিষ্কার ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। পরবর্তীতে নহলী নাট্যদলে যোগ দিয়ে মনোজ মিত্রর লেখা “চমচমকুমার” নাটকের মাধ্যমে নাট্যদলে নাটক করা শুরু হয়েছিল মনোজিতের।
সেখানেই আটকে থাকেনি তার থিয়েটার জীবন।থিয়েটার নিয়ে বাঁচার তাগিদে নানা নাট্যদলেই অভিনয় করেছে সে। নহলী ছাড়াও মাচার মানুষ, খড়দা থিয়েটার জোন, থিয়েটার জেড প্রভৃতি নাট্যদলেও সে অভিনয় করেছে। তবে নিজের দলের নির্দেশক হয়ে যাওয়ার পর সেই দলেই ( রঙ্গশীর্ষ) বেশি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় তাকে। অবশ্য তার পাশাপাশি ফ্রীল্যান্সার হিসাবে বিভিন্ন নাট্যদলেও অভিনয় করে চলেছে।
অভিনয় জীবনে তার অভিনীত চরিত্রের সংখ্যা অনেক। সব চরিত্রই তার কাছে প্রিয়। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মনোজিৎ জানিয়েছে, অভিনেয় চরিত্রটাকে ভাল না বাসলে তো সেই চরিত্রে ভাল অভিনয় করা যায় না। তাই অভিনীত সব চরিত্রই তার কাছে প্রিয়। তবে “ভাসান” নাটকে পাগলের চরিত্রটা তার কাছে বেশি প্রিয়। এছাড়া “নৈনং দহতি পাবক” নাটকে জোকার চরিত্রটাও তার অন্যতম প্রিয় চরিত্র। এই চরিত্রদুটো আর পাঁচটা চরিত্রের থেকে একটু অন্যরকম বলেই বেশি প্রিয়।
একসময় তার মনে হত, থিয়েটার মানে শুধুই অভিনয়। কিন্তু এখন দীর্ঘ ১৪-১৫ বছরের থিয়েটারজীবনে তার মনে হয়, শুধু অভিনয় নয় – থিয়েটার মানে থিয়েটারের সমস্ত রকমের কাজকে ভালবাসতে হয়। নাটকের রিহার্সাল রুম পরিষ্কার করা থেকে সেট ডিজাইন, আলো, আবহ, টিকিট বিক্রি, ফ্লেক্স লাগানো, হ্যান্ডবিল বিলি ইত্যাদিকেও ভালবাসতে হয় এবং অবশ্যই অভিনয় নামক শিল্পটিকে। সে অনুভব করেছে, থিয়েটারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে অনেক।তাই নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য, পাল্লা দেওয়ার জন্য থিয়েটারের সব রকম কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে হয় বলে তার ধারণা। তার মনে হয়,প্রতিটা দিন নতুন কাজ করতে না পারলেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হয়। এখন সে অনুভব করে, থিয়েটার করাটা অত সহজ নয়। সাম্প্রতিক থিয়েটারের সঙ্গে তাল দিতে কঠোর পরিশ্রম করা দরকার। পাশাপাশি থিয়েটার নিয়ে প্রচুর পড়াশুনোও দরকার বলে তার মনে হয়। আর এজন্য থিয়েটারের বিভিন্ন সুখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের অধীনে প্রচুর কর্মশালা করেছে মনোজিৎ। থিয়েটার করে জীবিকা নির্বাহ করতে হলে এই পরিশ্রমটা করতে হবে বলে সে বিশ্বাস করে। তবে এটাও বিশ্বাস করে, থিয়েটারের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করলে থিয়েটারও অনেক কিছু দেবে।মান,সম্মান,প্রতিপত্তি, অর্থ সব। তাই এত মানুষ থিয়েটার করেও বেঁচে আছে।
শুধু থিয়েটারের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নিজে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে মনোজিৎ। একটা তরতাজা যুবক চাকরী না করে শুধু থিয়েটার করে বাঁচবে – এটা মেনে নিতে পারেনি তার বাড়ির মানুষজন। দলের সদস্যরাই এখন তার পরিবারের মানুষ। এমন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে থিয়েটার করে যাচ্ছে মনোজিৎ।
তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল : চমচমকুমার, মর্গে, কুঁজো আর ভূত, উৎসরজন, ভাসান, নৈনং দহতি পাবক, বোহেমিয়া, ঘ্রাণ,মৃত্যুদেশ। নহলী, রঙ্গশীর্ষ, মাচার মানুষ, থিয়েটার জেড প্রভৃতি নাট্যদলের প্রযোজনা এগুলি। চিত্র পরিচালক শঙ্খ ঘোষের পরিচালনায় থিয়েটার জেড দলে “আন্তিগোণে” তার অভিনীত একটি উল্লেখযোগ্য নাটক।
থিয়েটারে বাঁচি আমি, থিয়েটারেই মরি – এই বিশ্বাস নিয়ে থিয়েটার করে চলেছে মনোজিৎ। বরং বলা ভাল, থিয়েটারে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সে। তার বিশ্বাস, এ লড়াইএ সে জিতবে। সেই বিশ্বাস নিয়েই থিয়েটারের অনন্ত পথে হেঁটে চলেছে মনোজিৎ মিত্র।