বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ১৩
দমদমে বেড়ে ওঠা পারমিতা ঘোষ থিয়েটারে এসেছে মূলত দিদি নবমিতা ঘোষের হাত ধরে। দিদি যুক্ত কয়াডাঙা সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাথে। সেই দলেই পারমিতা থিয়েটার করতে এসেছে দিদির প্রশ্রয়েই। ১২ বছর থিয়েটারে জড়িয়ে থাকা পারমিতা রসায়ন শাস্ত্রে সাম্মানিক উত্তীর্ণ। অর্থাৎ লেখাপড়ার পাশাপাশি সমানতালে থিয়েটারে যুক্ত। বাড়িতে বাবা গান গাইতে ভালবাসেন, দিদি থিয়েটার করে, সুতরাং সেই পরিবারের দ্বিতীয় কন্যাটির থিয়েটারে আসার জন্য খুব একটা লড়াই করতে হয়নি।
পারমিতা জানিয়েছে, দিদি নবমিতার সাথে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সূত্রে সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নির্দেশক রাজেশ দেবনাথের পরিচয়। তারপর দিদি নবমিতা সবুজ সাংস্কৃতিক দলে দীর্ঘদিন জড়িয়ে।আর সেই দিদির সূত্রেই তার থিয়েটারে আসা। ২০১২ সাল থেকে সবুজ দলেই আছে, থাকতেও চায়।
রবি ঠাকুরের দুই নারী চরিত্র নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে থিয়েটারের ভুবন প্রথম চিনেছিল পারমিতা। তারপর সবুজের নানা নাটকে নানা চরিত্রে অভিনয় করে চলেছে। অবশ্য সবুজ ছাড়া অশোকনগর নাট্যমুখ এবং অবশিষ্ট দলে একটি করে নাটকে অভিনয় করেছে পারমিতা। সেই নাটকগুলি হল অশোকনগর নাট্যমুখ এর কুহকিনীর দিনরাত্রি এবং অবশিষ্ট দলের মহাযানের আয়না। অন্য দলের হয়ে এই দুটি নাটকেই সে অভিনয় করেছে। তবে মনেপ্রাণে জড়িয়ে সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সঙ্গে।
এ পর্যন্ত তার অভিনীত নাটকের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। নানা নাটকে নানা চরিত্রে অভিনয় করলেও লেডি ম্যাকবেথ নাটকের ফার্স্ট উইচ চরিত্রটি তার অভিনীত সর্বাধিক প্রিয় চরিত্র। অবশ্য তার পিছনে একটা কারণও আছে। কারণ চরিত্রটা তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। এ নাটকে ফার্স্ট উইচ চরিত্রে অন্যজন অভিনয় করত। কিন্তু বিশেষ কারণে নাটকের শো এর দিনে সেই অভিনেত্রী অভিনয় করতে পারবে না বলে জানালে সেই চরিত্রে পারমিতা মঞ্চে নামে। কিন্তু সেদিন তার সাফল্যের মূলে ছিল তার আর একটি গুণ। অভিনয় না করলেও যে কোন নাটকের রিহার্সালে উপস্থিত থাকে পারমিতা। রিহার্সাল দেখতে দেখতে নাটকের পুরো স্ক্রিপ্ট তার মুখস্থ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, সব চরিত্রের সংলাপও তার মুখস্থ থাকে। তাই সেই চ্যালেঞ্জটা নিতে একটুও ভাবেনি পারমিতা। নাটকের পরে সবার কাছে অভিনন্দন পেয়ে অভিভূত হয়েছিল। তাই ফার্স্ট উইচ তার প্রিয়তম চরিত্র।
থিয়েটার করতে এসে অনেকেরই অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বর মধ্যে থাকতে থাকতে থিয়েটার জগৎ সম্পর্কে একটা নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে।কিন্তু পারমিতা স্পষ্ট উত্তরে জানিয়েছে, পজিটিভ ধারণা নিয়েই সে থিয়েটার করতে এসেছে।স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে থিয়েটারটা করে যেতে চায় সে। কোন নেগেটিভ ধারণা বা ঘটনাকে সে পাত্তা দেয় না। বরং পারমিতা প্রত্যাশা করে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিক থিয়েটার। আধুনিক থেকে আরো আধুনিক হয়ে উঠুক। তাই থিয়েটারের জগৎ তার কাছে একটা আনন্দের জগৎ।
থিয়েটার এবং থিয়েটারের জগৎ নিয়ে তার একটা বাড়তি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল দিদি নবমিতাকে দেখে। পারমিতা জানিয়েছে, ছোটবেলা থেকেই আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মতই বিভিন্ন সিনেমার পরিচিত সংলাপগুলো বলার তার একটা অভ্যাস ছিল। তারপর দিদি থিয়েটারের সাথে যুক্ত হওয়ার পরে দিদির সাথে রিহার্সাল দেখতে এবং দিদির দলের নাটক দেখতে যাওয়া সে অভ্যাস করে ফেলেছিল। এর ফলে থিয়েটারের প্রতি তার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি হয় এবং একসময় থিয়েটারে অভিনয় করা শুরু করে। থিয়েটার করে দর্শকের কাছ থেকে যে ভালবাসা বা প্রশংসা পায়, সেটাই তাকে আর একটা থিয়েটার করার জন্য উৎসাহিত করে।
বেশ কম বয়সেই থিয়েটারে যুক্ত হয়েছিল। কারণ থিয়েটার করার জন্য পারিবারিক নিষেধ আসেনি। কারণ তার দিদি আগেই থিয়েটারে যুক্ত হয়ে সেই পথটা পরিষ্কার করে রেখেছিল। তবে একটু কম বয়সে থিয়েটারে জড়িয়ে পড়াটা সেই মুহূর্তে বাড়ির মানুষজনের কিছুটা অনিচ্ছা থাকলেও পরে সেটা তাঁরা মেনে নিয়েছেন। রসিকতা করে পারমিতা বলল, আসলে বাড়িতে সবাইকে বোঝাতে পেরেছিলাম, থিয়েটার ছাড়া পারমিতা আলু ছাড়া বিরিয়ানির মত। তাই আপত্তি আসেনি।
থিয়েটারে নিজেকে থিয়েটারের উপযুক্ত করে গড়ে নিতে বেশ কিছু নাটকের কর্মশালা করেছে পারমিতা। নাট্য আকাদেমির কর্মশালার প্রেসিডেন্সি বিভাগে সুযোগ পেয়ে কর্মশালা করেছে। দু বছর পর পর নাট্য একাদেমির সেই ওয়ার্কশপে যোগ দিয়ে থিয়েটারকে সে আরো বেশি করে ভালবাসতে শিখেছে। এছাড়াও গোবরডাঙা নকশার অভিনয়ভিত্তিক কর্মশালায় এবং লাকিজী গুপ্তার একটি কর্মশালাতেও যুক্ত থেকেছে পারমিতা ঘোষ। লাকিজী গুপ্তার কর্মশালা হয়েছিল সবুজ দলের আয়োজনেই।
থিয়েটারে এতদিন জড়িয়ে থেকে তার মনে হয়েছে, ধৈর্য্য ধরে থিয়েটারে লেগে থাকলে থিয়েটারকে অবলম্বন করেও বেঁচে থাকা যায়। পারমিতা অভিনীত নাটকগুলি হল : রবি ঠাকুরের দুই নারী চরিত্র, লেডি ম্যাকবেথ, মিরর,ওয়েটিং ফর ইউ, দে এন্ড মাই ডায়েরি, মহাযানের আয়না, গালি দিবেননি কাক্কা, মরলে মরো ছড়িও না, প্লাটফর্ম নম্বর ৫, লুপ, স্পুকবুক, আজাদী। পারমিতা খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছে, সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কম বয়সে থিয়েটারে যুক্ত হয়ে থিয়েটার জগতে নিজেকে চিনিয়েছি। তাই সবুজে ছিলাম, সবুজে আছি, সবুজেই থাকব।