বিজয়কুমার দাস
আগে শীত পড়লেই যাত্রাদলের গাড়ি ছুটত চিৎপুর থেকে মফস্বল, শহর, গ্রামে। যাত্রা দেখতে ভিড় ছাপিয়ে যেত মণ্ডপে মণ্ডপে। দিলীপ চ্যাটার্জী, শান্তিগোপাল, স্বপনকুমার, তপনকুমার, বীণা দাশগুপ্তা, ছন্দা চ্যাটার্জীরা তখন মঞ্চ শাসন করতেন। এখন যাত্রার সেই স্বর্ণযুগ নেই। করোনার পরে চিৎপুরের সাম্রাজ্যে ধস নেমেছিল। আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাতেও এসেছে বিবর্তন। সেই যাত্রাকে প্রকৃত যাত্রাপ্রেমীরা মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। তবু সেই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা অবশ্য চলছেই। কলকাতার সরকার আয়োজিত যাত্রা উৎসব তার একটা দৃষ্টান্ত।
ঠিক শীতের মরশুমে যাত্রার মতই নাটকের দলগুলিও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শহরে মফস্বলে কলকাতায় শহরতলীতে এখন অনেক নাটকের দল। যারা গ্রুপ থিয়েটার হিসাবে পরিচিত। থিয়েটার যারা করে, তারা জানে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতেও মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় অনেককেই। অবশ্য কোন কোন নাট্যদল গ্রান্টের কৌলীন্যে বেশ সুখেই নাট্যচর্চা করেন। কিন্তু এই বাংলায় এমন অনেক নাট্যদল আছে যারা সুদীর্ঘ সময় নাট্যচর্চায় নিয়োজিত থাকলেও গ্রান্টের দাক্ষিণ্য লাভ করতে পারেনি। তাই বলে তাদের থিয়েটার থেমে থাকেনি।
নাটকপ্রেমী মানুষের কাছে আর্থিক সাহায্য নিয়ে, কার্ড বিক্রি করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গাঁটের কড়ি খরচ করে তারা থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই শেষোক্ত শ্রেণির থিয়েটারপ্রেমকে স্যালুট জানাতেই হয়। আবার এ কথাও সত্য অনেক ধুরন্ধর খোশামোদে তোষামোদে ঠিক অনুদান বা শো-এর ব্যবস্থা করে নিয়ে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি থিয়েটারের প্রসারের ভাবনায় গঠিত। নাট্য আকাদেমির নাট্যমেলায় কলকাতায় নাটক করার সুযোগ পায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রাম শহরের বহু নাট্যদল। আর্থিক সহায়তাও পায়। এ নিয়ে নানাজনের নানা অভিযোগ থাকলেও এই উদ্যোগকে প্রশংসা করতেই হয়। এখানেও মৌরসী পাট্টার অভিযোগ থাকলেও সরকারী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। নাট্যমেলাকে কেন্দ্র করে অনেক নাট্যদল তাদের নাটক কলকাতা বা অন্যান্য শহরের ভাল মঞ্চে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছে, এটাও কম কথা নয়।
তবে এর বাইরেও সারা রাজ্যে এমন অনেক নাট্যদল আছে যারা অনুদান পায় না, যাদের সরকারী নিবন্ধন হয়ে ওঠেনি, যারা নাট্যমেলায় কদাচিৎ সুযোগ পায়, অথবা নাট্যমেলায় এ পর্যন্ত সুযোগ পায়নি, সরকারী অনুদান পায়নি, গ্রান্ট পায়নি – বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সেতুবন্ধনে কাঠবেড়ালির মত হলেও তাকে উপেক্ষা করা যায় না। যারা কলকাতায় বা বড় শহরে থিয়েটার করে এবং যারা মফস্বলে, ছোট শহরে, গ্রামে যারা থিয়েটার করে -এই দুই শ্রেণির সমস্যা কিন্তু একরকম নয়। অনেক শহরেই নাট্যমঞ্চ আছে, নাটকের দর্শক আছে, টিকিট কেটে নাটক দেখার মানসিকতা আছে। কিন্তু গ্রামে বা ছোট শহরে নাটকের উপযোগী মঞ্চ নেই, টিকিট কেটে নাটক দেখার দর্শক নেই। নাটক করতে হয় গায়ের রক্ত জল করে। গাঁটের পয়সা খরচ করে। থিয়েটার এভাবেও বেঁচে আছে গ্রাম – শহরে।
কলকাতায় যাঁরা থিয়েটার করেন আর কলকাতার বাইরে যাঁরা থিয়েটার করেন সেই দুই শ্রেণির সমস্যা কিন্তু এক নয়। কলকাতায় বহু নাট্যমঞ্চ আছে, স্টার অভিনেতা অভিনেত্রী আছে, অনেক অসাধারণ নাট্যদল আছে, নাটকে অভিনয়ের মানসিকতাও আছে অনেকের।সেখানে টিকিট কেটে নাটক দেখার দর্শকও আছে। কিন্তু শহরে, গ্রামে, গঞ্জে এগুলোর অভাব আছে। তবু বলতেই হয়, এইসব প্রতিবন্ধতার সঙ্গে লড়াই করেও কলকাতার বাইরে বহু জেলার দল অত্যন্ত ভাল নাটক করছে। থিয়েটার এভাবেই বেঁচে আছে জেলায় জেলায়। থিয়েটার এভাবেই বেঁচে আছে শহরে, গ্রামে।
শীতের মরশুমে আগে রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটত যাত্রাদলের গাড়ি। এখন পাল্লা দিয়ে ছোটে নাট্যদলের গাড়ি। এছাড়া ট্রেনে, অটোতে, টোটোতে করেও নাটকের দল পৌঁছে যাচ্ছে। কোথাও দর্শক বেশ ভাল। কোথাও দর্শক কম। কিন্তু থিয়েটার চলছে।শীত যত জমে ওঠে। থিয়েটারও তত জমে ওঠে। কলকাতার নাটকের দল পৌঁছে যায় মালদায়, মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদ, মালদা, বীরভূমের নাটকের দল পৌঁছে যায় উত্তরবঙ্গে, বর্ধমানে, বাঁকুড়ায়।
সুখের কথা এই যে, থিয়েটার কিন্তু বহমান স্রোতের মত বয়ে চলেছে। কলকাতায় বিভিন্ন দলে বহু ছেলেমেয়ে থিয়েটারকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে। তাদের লড়াইকে কুর্ণিশ করতেই হয়। কারণ থিয়েটারকে সম্বল করে বাঁচা বড় কঠিন। তবু একটা শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তারা এই কঠিন ব্রত যাপন করে চলেছে।
করোনাকালে থমকে দাঁড়ানো থিয়েটার আবার শিরদাঁড়া সোজা করে লড়াই শুরু করেছে। রাজ্যের এমন অনেক নাট্যদল আছে, যারা অনুদান পায়নি, যারা নাট্যমেলায় ডাক পায়নি, বছরে বেশি শো পায় না। কিন্তু তারাও থিয়েটারটা চালিয়ে যাচ্ছে। সারা বছরই প্রতিটা দিন রাজ্যের কোন না কোন মঞ্চে থিয়েটার হচ্ছেই। তাই থিয়েটারের জন্য এ লড়াই চলছে চলবে। এভাবেই বেঁচে থাকার গান শোনাবে থিয়েটার। হোক থিয়েটার।