দেবা রায়, কলকাতা
গত ২৯ শে জানুয়ারী থেকে তিন দিন ব্যাপী গড়িয়া একত্রে নাট্যোৎসব (Natyotsab) সপ্তম নাট্যোৎসব শেষ কলকাতার তপন থিয়েটার মঞ্চে। এই উৎসব উদ্বোধন করার কথা ছিলো বিশিষ্ট পরিচালক, অভিনেত্রী ও শিক্ষিকা সোহাগ সেনের কিন্তু শারীরিক কারণে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেন নি। তবে উপস্থিত ছিলেন প্রাবন্ধিক ও নাট্য পরিব্রাজক রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় এবং তিন নাট্যকার রজত ঘোষ, অনুপ চক্রবর্তী ও সোমনাথ খাঁ।
তিন দিনে মোট আটটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। এই উৎসবে (Natyotsab) অংশগ্রহণকারী দলগুলি আগরপাড়া থিয়েটার পয়েন্ট, যাদবপুর মন্থন, ধ্রুপদ নাট্যদল, মিউনাস, উষ্ণিক, আভাষ, বারাসাত অনুশীলনী ও আয়োজক গোষ্ঠী তাদের নবতম প্রযোজনা গড়িয়া একত্রে।
উৎসবের প্রথম দিনে রমানাথ রায়ের গল্প সূত্রে ও রজত ঘোষের রচনায় একটি নাটক তাঁরা মঞ্চস্থ করেছেন। রজত ঘোষের নাট্যকাহিনীর বুনন এতোটাই মজবুত যে এই নাটক দেখতে দেখতে দর্শকের প্রতিক্রিয়া কানে ভেসে আসে। সহ্যের সীমা অতিক্রম করে বাপ যখন কুলাঙ্গার ছেলেকে চড় মাড়ে, তখন দর্শকাসন থেকে ‘বেশ হয়েছে’ ‘ঠিক করেছে’ গোছের প্রতিক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করে এই নাটক মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে এবং আগামী দিনেও নেবে।
বর্তমান নাট্যচর্চার একঘেয়েপনা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে এই নাটক। এবং অনেকাংশেই সফল বলা যেতে পারে। একান্নবর্তী পরিবার কবে ভেঙ্গে গিয়েছে। এখনতো সন্তানাদি চলে যাচ্ছেন দেশ ছেড়ে বিদেশে। মা-বাপ কিভাবে আছেন সে খেয়াল তারা রাখবার সময়ই পায় না। এমনই এক নাট্য ঘটনায় নির্মিত ‘মৃত্যুর তারিখ’।
কেন্দ্রীয় চরিত্র স্ত্রীহারা হরিচরণ (অভিনয়ে ভাস্কর সান্যাল) একাকী এক কন্যাসম পরিচারিকার সেবায় বনেদিয়ানার প্রাচীরের অভ্যন্তরে বাস করেন। এই একাকীত্ব মেনে না নিতে পেরে বার বার বিদেশে থাকা তিন ছেলেকে ফোন করে তাকে দেখতে আসার কথা বলেন। আবেদনের সাথে থাকে বাপের ‘আর বেঁচে না থাকা’র আর্তি। অথচ ছেলেরা যারা কর্পোরেটের জালে আবদ্ধ থেকে বিদেশ বিভূঁই থেকে আসতে পারে না। বা আসার জন্য ব্যয় হয় অনেক। অথচ বিদেশে থাকা তিন সন্তান কে দেখার জন্য ক্রমাগত ছটফট করতে থাকেন বাপ। প্রাচীরের আবহে ধাক্কা খেয়ে ভেসে আসা নেপথ্য কণ্ঠ যা গল্প বুননে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে। বাপের ঘনঘন ফোনে ছেলেরা যারপরনাই বিরক্ত হন, তাদের বাপের কাছে আসাকে সময়ের অপচয় বলে মনে হয় ইত্যাদি। এরপর তারা বাপকে আল্টিমেটাম দেয়। বার কয়েক মরে যাবেন বলেও মরছেন না বলে এবার তারা বাপের কাছে ‘মৃত্যুর কনফার্ম ডেট’ জানতে চায়। এবং সেই অনুযায়ী তারা দেশে আসবেন।
‘মৃত্যুর কনফার্ম ডেট’ এই শব্দবন্ধ যেন নিমেষে গোটা প্রেক্ষাগৃহ পরিমণ্ডলে আন্দোলিত হতে থাকে। স্বভাবতই ভেঙ্গে পড়েন হরিচরণ। ঘটনার আবর্তে পাক খেতে থাকে বৃদ্ধ পিতা। একাকীত্বের অসহায়তা তো ছিলোই কিন্তু এরা কোন সন্তান! যারা এরকম একটা ভাবনায় নিজেদের প্রস্তুত করেছে। তিনি তো মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন না । তিনি হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে প্রথমে ডাক্তার এবং তার পরামর্শে সনাতন ভৃগুর কাছে যান। সেখানে ভৃগু অনেক টাকার বিনিময়ে মন্ত্রপূত আংটি দেন, এবং গণনায় তাকে মৃত্যুর কনফার্ম ডেট জানান।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছেলেরা বাপের কাছে উপস্থিত হন। মৃত্যুর রাত্রে বাপের সামনে বসে তিন ছেলের একসাথে মদ্যপানের আসরের দৃশ্য এক লহমায় সামাজিক অবক্ষয়ের ছবি দর্শকের সামনে তুলে ধরে। লাম্পট্য এবং আদর্শবান বৃদ্ধ পিতার দৃঢ়তা দৃশ্যের গভীরতা প্রকাশে সম্পূর্ণ সার্থক নির্দেশক ভাস্কর সান্যাল।
নাটকের আঙ্গিকে পরতে পরতে হাস্যরস মাখামাখি হয়ে আছে। এবং সেই হাস্য রসের আড়ালে যে এক গভীর ট্রাজেডি লুকিয়ে ছিলো তা দর্শক আঁচ করছিলেনই। অমরত্ব নিয়ে কেউই আসেন না এই পৃথিবীতে, কিন্তু যে মৃত্যুকে মানসিক প্রস্তুতি সাথে আনতে হয় সেটা হরিচরণের চরিত্র নির্মানে ভাস্কর সান্যাল অসাধারণ দক্ষতায় ও অভিনয় গুণে ফুটিয়ে তুলেছেন।
তিন ছেলে যথাক্রমে অমল- অরিজিত ভট্টাচার্য, বিমল-বিপ্লব দাস, কমল- সুমন সাহা নেগেটিভ চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে আপ্রান চেষ্টা করেছে। কয়েকটি জায়গায় তাদের সংলাপ ক্ষেপণে ছন্দ হারালেও সার্বিকভাবে ঠিকই মনে হয়েছে। বন্ধু রূপে দীনবন্ধু- শংকরীপ্রসাদ মিত্র এবং ডাক্তার চরিত্রে কার্তিক মন্ডল ও সনাতন ভৃগু চরিত্রে ধ্রুব মুখার্জী তিন জনের অসামান্য অভিনয় নাট্য নির্মানে কাঠামোর ভূমিকা পালন করেছে। কণ্যাসম পরিচারিকা গায়ত্রী- সুরঞ্জনা মন্ডল মন্দ অভিনয় করেন নি। যদিও মূল চরিত্রের সাথে সংলাপ আদান প্রদানে আরো সাবলীল হতে হবে। কারণ হরিচরণ রূপী ভাস্কর সান্যালের অভিনয় সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অলোক ব্যনার্জী, স্বস্তিকা হুই, জ্যোতিষ্মান ভট্টাচার্য সকলেই যথাযথ।
বিচার কি হওয়া উচিত ছিলো তার চাইতেও বড়ো কথা একটি নাটকে মঞ্চের মধ্য দিয়ে যা ঘটলো, তা এক কথায় অনবদ্য। মঞ্চের বিভিন্ন স্পেস ব্যাবহার করে পরিচালক নাটকটিকে টানটান হয়ে দেখায় সাহায্য করেছেন।
নাটকের বিন্যাস আর নির্মানে খুব একটা খামতি চোখে আসেনি, কারণ নাটকটি ভীষণভাবেই অভিনয় নির্ভর। আলোর ভাবনায় বাবলু সরকার বেশ ভালো বিশেষ করে লাইটকে ট্রলি করে চরিত্র ফলো করার বিষয়টি তবে নড়চড়ার সময় শব্দ নাট্য আবহকে খানিক ব্যহত করেছে। নীল কৌশিকের স্থায়ী মঞ্চ ও দৃশ্য বিন্যাসে পরিবর্তন বেশ মানানসই। আবহ এই নাটকের একটি বিশেষ দিক। সেখানে আরো যত্নশীল হওয়ার সুযোগ আছে। নাটকের শুরুতে ঘরের দেয়ালে রাখা একটা চাবুকের ব্যবহার বেশ ইঙ্গিতবাহী কিন্তু নাটকের ক্লাইমেক্সে এসে তার ব্যবহার আর দেখা যায় নি। হয়তো হরিচরণের ব্যাক্তিত্ব প্রকাশের জন্য একটি ‘চড়’ই যথেস্ট ছিলো বলে মনে করেছেন নির্দেশক। কিন্তু চাবুকের ব্যবহার সেই স্থলে থাকার অবকাশ ছিলো। কারণ এটি সামাজিক ক্ষয়ের একটি দৃষ্টান্ত যাকে আঘাত করা প্রকারন্তরে একটি সামাজিক বার্তা দেয়া।
নাট্যক্রিয়ার পরিণতি দেখার জন্য সকলকে নাটকটি দেখতে হবে। সার্বিকভাবে এই নাটক এবং তাঁদের উৎসবের মাধ্যমে গড়িয়া একত্রে বাংলা নাট্য চর্চায় অনেকটা লম্বা পা রেখে এগিয়ে গেলেন। নাটকটি বহু অভিনয় হওয়া উচিত।